কিন্তু না। ওরা বার বার আকাশের দিকে তাকাচ্ছে।
তারপর হঠাৎই গাঁইতি রেখে দিয়ে ওরা জেকবকে ব্যস্ত হয়ে বলল, আমরা এখন চললাম।
জেকব প্রচণ্ড রেগে বলল, চললে মানে? আর একটু খুঁড়লেই ভেতরে ঢুকতে পারব। এখন চললাম বললে হবে না।
ওরা একসঙ্গে বলল, না। সন্ধে হয়ে আসছে। সন্ধের আগেই আমাদের ঘরে ঢুকতে হবে।
তারপর আকাশের দিকে আঙুল তুলে নিজেদের মধ্যে কী বলাবলি করল।
তাকিয়ে দেখলাম ঘন কালো মেঘ উত্তর-পশ্চিম কোণে জমে উঠেছে। একে তো চারিদিক নিস্তব্ধ, লোকজনের চিহ্নমাত্র নেই। যে গরু-মোষগুলো মাঠে চরছিল তারাও ফিরে গেছে।
আদিবাসীরা শুধু পালাল না, ছুটতে লাগল। সে ছোটা যেমন তেমন ছোেটা নয়, প্রাণভয়ে ছোটা।
অনেক পরে জেনেছিলাম ওদের সংস্কার, ফাল্গুনের বিকেলে যদি মেঘ ওঠে, ঝড় হয় তাহলে তা বিপদের সংকেত।
জেকব ব্যাজার হয়ে বললে, সব ভীতুর একশেষ। একটুর জন্যে কাজটা শেষ হলো না।
এমন সময় মাঠের ওদিক থেকে গোঁ গোঁ করে শব্দ উঠল। আমরা চমকে উঠলাম। প্রচণ্ড ঝড় আসছে।
এই ধু-ধু মাঠের মধ্যে ঝড়ের মুখে পড়লে রক্ষে নেই। তাই আমরাও ঘরমুখো ছুটতে লাগলাম।
.
মৃত্যুগুহা
৯ মার্চ রাত দুটো
সারা রাত ঝড়ের দাপট ছাড়া আর কোনো ঘটনা ঘটেনি। পরশু দিন রাতে যে আজানধ্বনি বা ঘোড়ার ছোটাছুটির শব্দ শুনেছিলাম, গত রাতে সেরকম শুনিনি।
আজ সকালে উঠেও দেখি আকাশের মুখ ভার। জেকবের মুখ ততোধিক ভার। মাঝে মাঝে শোঁ শোঁ করে দমকা বাতাস দিচ্ছে। এ এক অকাল দুর্যোগ।
জেকবকে দেখছি ঘরের মধ্যে ছটফট করছে। খোঁড়ার কাজ অসমাপ্ত পড়ে আছে। এখানকার চোর-ডাকাতদের ভয় নেই। তারা আর যাই হোক মৃতের কবরকে সম্মান করে কিংবা ভয় করে। ভয় বিদেশী চোরদের। এইসব বিদেশী চোর-ডাকাতের অভাব নেই। সন্ধান পেলে তারা ঢুকে পড়বে। আর একবার ঢুকে পড়তে পারলে ফিরোজ শাহের ধনরত্ন সব ফাঁক করে দেবে। তাছাড়া ঝড়ের সঙ্গে যদি বৃষ্টি নামে তাহলে তো সব কাজ পণ্ড। কবরের মুখে জল ঢুকে গেলে বসে থাকতে হবে জল শুকোনো পর্যন্ত। কিন্তু জেকব আর একটা দিনও বসে থাকতে চায় না।
জেকব আমার সঙ্গে একটা কথাও বলছে না। আমি যেন ফালতু লোক। অথচ আমায় ছেড়েও দিচ্ছে না। ছেড়ে দিলে তো আমি বাঁচি।
শেষ পর্যন্ত ঝড় একটু থামলে বেলা তিনটে নাগাদ আবার সকলে রওনা হলাম। আদিবাসীরা কিছুতেই যাবে না। ওরা বলছে, মাটি খুঁড়তে খুঁড়তে সন্ধে হয়ে যাবে।
জেকব ওদের বোঝাল পাঁচটার আগেই তাদের ছেড়ে দেবে।
পাঁচটার আগেই ওরা চলে গেল। অবশ্য তখন খোঁড়ার কাজ শেষ। ধুলোয় ঢাকা একটা বেঁটে দরজার সামনে এসে আমরা দুজনে দাঁড়িয়েছি। বোঝা গেল সমাধিগৃহে ঢোকবার এটাই দরজা। দরজাটায় চমৎকার কারুকার্য করা। এত বছরেও সেসব কাজ নষ্ট হয়েনি। কিন্তু দরজাটা এত নিচু কেন?
বুঝতে পারলাম এই পবিত্র সমাধিগৃহে যাতে মাথা নিচু করে ঢুকতে হয় তারই জন্যে এই ব্যবস্থা।
জেকব নিজের মনেই যেন বললে, যাক, এখানে আমরাই প্রথম। আজ পর্যন্ত কোনো চোর এ জায়গার সন্ধান পায়নি।
ইতস্তত করে বললাম, এই সন্ধেবেলা আমরা ঢুকব?
জেকব খেঁকিয়ে উঠে বলল, তবে কি চোরেদের জন্যে দরজা খুলে রেখে যাব? টর্চ বের করো।
দরজাটার কড়ার সঙ্গে একটা মোটা শেকল বাঁধা ছিল। জং ধরে গিয়েছিল। জেকব ঝুলি থেকে দুটো যন্ত্র বার করে শেকলে চাপ দিতে লাগল। অনেকক্ষণের চেষ্টায় শেকল ভাঙল না বটে কিন্তু কড়া দুটো উঠে এল।
এবার ওর সঙ্গে আমাকেও দরজা ঠেলতে বলল। দুজনে জোরে ধাক্কাধাক্কি করতেই একটা বিকট শব্দ করে দরজাটা খুলে গেল। একরাশ ধুলোর সঙ্গে একটা ভ্যাপসা গন্ধ নাকে এসে ঢুকল। আমরা দুজনেই নাকে রুমাল চাপা দিলাম।
মিনিট পাঁচেক পরে আমরা টর্চ জ্বেলে ভেতরে ঢুকলাম। কালো পাথরের টালি দিয়ে গাঁথা মেঝে। ভেতরে ঘুটঘুঁটে অন্ধকার।
আমার গা-টা ছমছম করতে লাগল। পাঁচশো বছর পর এ কোন প্রেতপুরীতে আমরা ঢুকছি!
হয়তো ভয়ের কোনো কারণই থাকত না যদি না মাত্র পরশু রাত্রেই আমার সেই ভয়ঙ্কর অভিজ্ঞতা হতো। এখানে আসার আগে থেকেই আমি কিছু অলৌকিক ব্যাপার প্রত্যক্ষ করেছি। এক নম্বর সেই কাকটা–গুলি খেয়েও যেটা মরেনি। দ্বিতীয় নম্বর কেন এক্কার ঘোড়াটা পিয়াসবারি দীঘির আগেই থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল? কেন আর এক কদমও এগোল না। তৃতীয়ত ফকির সাহেব। যে নাকি সারা রাত্রি গোটা গৌড় পাহারা দিয়ে বেড়ায়। কাজেই এই কবরগৃহ যে শুধুই একটা পুরনো কবরস্থান তা নাও হতে পারে। এটা যে ভয়ঙ্কর জায়গা, এখানে এলে যে বিপদ অবশ্যম্ভাবী, ফকির সে কথা বলে আমায় সাবধান করে দিয়েছিল।
এসব কথা মনে হতেই আমার পা দুটো অসাড় হয়ে গেল। আর এক পাও এগোতে সাহস হলো না।
জেকব ধমক দিয়ে বললে, হাঁ করে দাঁড়িয়ে রইলে কেন? তাড়াতাড়ি এসো।
তার সেই কণ্ঠস্বর চাপা ঘরের চার দেওয়ালে ধাক্কা খেয়ে গমগম করে উঠল।
সঙ্গে সঙ্গে স্পষ্ট শুনলাম, কাছেই কোথায় মৃদু শব্দ হলো। শব্দটা শুনে মনে হলো কিছু যেন নড়ে উঠল। কেউ যেন সংকীর্ণ জায়গার মধ্যে পাশ ফিরল।
শব্দটা জেকবও শুনেছিল। দেখলাম সেও কান খাড়া করে দাঁড়িয়ে পড়ল।
তারপরই যেন নিজের মনেই বলল, ও কিছু না।
আমাকে আদেশ করল, আমার পাশে পাশে এসো।
আমি বললাম, জুতোটা খুলব?