গাইডই তাহলে আমায় এত দূরে টেনে নিয়ে এসেছে!
গাইড বললে, মাৎ ডরো ছোটিবাবু। ভয় পেও না। এই যা সব শুনেছ, যা দেখলে এসব এখানে হামেশাই ঘটে। কোনো সুলতান বেগম উজির সেনাপতিই খোদার নাম নিয়ে শান্তিতে মরেনি। শুধু কাটাকাটি, খুন, রক্তপাত। এন্তেকাল হবার পরও তাদের আত্মার শান্তি হয়নি।
একটু থেমে সে আবার বললে, কিন্তু যে জন্যে তোমাকে ডেকে এনেছি সে কথা বলি। তুমি ঐ বড়বাবুকে ছেড়ে পালাও। ও মানুষটা ভালো নয়। তোমার ক্ষতি করবে। কাল ও যেখানে তোমাকে নিয়ে যেতে চাইবে তুমি সেখানে কিছুতেই যেও না। সে জায়গা বড়ো সাংঘাতিক।
বললাম, কিন্তু ফকির সাহেব, আমি যদি ওর কথা না শুনি তাহলে ও আমায় মেরে ফেলবে। ওকে আমার বড় ভয়।
ফকির যেন নিজের মনেই বললে, ছোটিবাবু, ভয় কি শুধু ওনাকেই? ভয় যে আরও আছে … ঠিক আছে যদি তোমাকে যেতেই হয় তাহলে আমার এই চিমটেটা তোমার কাছে রাখো। এটা দিয়ে কাউকে আঘাত করতে যেও না।
এই বলে ফকির তার হাতের চিমটেটা আমাকে দিল।
তারপর বলল, তবে তুমি যখন এখান থেকে চলে যাবে, এটা রেখে যেও।
কোথায় রাখব?
ফকির বললে, পিয়াসবারির পাড়ে।
এতক্ষণে জিগ্যেস করলাম, ফকির সাহেব, আপনি এই গভীর রাতে কোথা থেকে এলেন?
ফকির বললে, আমি তো দিন রাত এখানেই থাকি।
দিনরাত কি করেন?
দিনের বেলা গাইড। রাতের বেলা পাহারাদার।
আপনি পাহারা দেন?
ফকির সাহেব হাসল একটু। কালো মুখের মধ্যে থেকে ধবধবে সাদা উঁচু উঁচু দাঁতের সারি ঝিকিয়ে উঠল। আমার গা শিউরে উঠল। কে ও?
সাহস করে বললাম, কী পাহারা দেন? এখানে কিইবা আছে?
তামাম গৌড় সাম্রাজ্য পাহারা দিই। এখানে কী নেই? অনেক কিছু আছে।
কবে থেকে পাহারা দিচ্ছেন?
ফকির বললে, ৯৮৫ আলহিজরা। যেদিন আফগান শূর সুলতান মুজাফফর খানতুরবতিকে হত্যা করা হলো সেদিন থেকে।
আমি চমকে উঠলাম, মুজাফফর খানতুরবতিকে খুন করার সময় যদি ৯৮৫ আলহিজরা হয় তাহলে সেটা ১৫৮০ সালের কথা!
অবাক হয়ে তাকাতে দেখি ফকির অন্ধকারে মিলিয়ে যাচ্ছে।
.
কবর-গৃহের সন্ধানে
৮ মার্চ বেলা এগারোটা
বেলা এগারোটা নাগাদ জেকব মোহন মাণ্ডি আর কয়েকজন আদিবাসীকে নিয়ে বেরিয়ে পড়ল। ওদের হাতে কোদাল, শাবল, গাঁইতি। তাছাড়া জেকবের কাঁধে যে ঝোলাটা রয়েছে তার মধ্যেও নিশ্চয় কিছু যন্ত্রপাতি আছে।
জেকব আমাকে আদেশ করল, আমার পাশে পাশে হাঁটো। পিছিয়ে পড়ার চেষ্টা করবে না।
ও ভেবেছে আমি হয়তো পালিয়ে যাবো। পালিয়ে গিয়ে হয়তো ওর মতলব ফাঁস করে দেব।
আমি তাই নিষ্প্রাণ পুতুলের মতো ওর পাশে পাশে চললাম। কোথায় যাচ্ছি কত দূরে যাচ্ছি তা জানি না। মনে পড়ল গত রাতের কথা। ফকিরের সেই কথাগুলো, ছোটিবাবু, বড়বাবু যেখানে নিয়ে যেতে চাইবে সেখানে যেও না।
কিন্তু উপায় নেই। যেতে হচ্ছে। ভরসা শুধু ফকিরের দেওয়া চিমটেটা।
জেকব ব্যঙ্গ করে বলেছিল, ওটা আবার পেলে কোথায়?
বলেছিলাম, মাঠে কুড়িয়ে পেয়েছি।
ঠাট্টা করে বলেছিল, রেখে দাও। সাপ-ব্যাঙ সামনে পড়লে মারতে পারবে।
ক্রমে আমরা ভাঙা প্রাসাদ, মসজিদ ছাড়িয়ে একটা প্রান্তরে এসে পৌঁছলাম। জেকব এগিয়ে চলেছে। যেন ইতিমধ্যেই জায়গাটা চিনে রেখেছে। নির্জন প্রান্তর। দূরে দূরে গরু, মোষ চরছে। এপাশে-ওপাশে দুতিনটে দীঘির মতো পুকুর। এসবই একদিন সুলতানদের কেউ না কেউ তৈরি করেছিলেন। আজ তাদের কথা কেউ জানে না।
ফাল্গুন মাস। এরই মধ্যে রোদের তেজ বেড়ে উঠেছে। জেকব ব্যাগ থেকে একটা টুপি বার করে মাথায় চাপিয়ে নিল। একে তো বেঁটে কালো চেহারা। তার ওপর যখন টুপি মাথায় পরে গটগট করে হাঁটছিল তখন ওকে মনে হচ্ছিল একটা ক্ষুদে শয়তান।
কিছুদূর এগিয়ে একটা ভাঙা পাঁচিল দেখা গেল। বোঝা গেল এক সময়ে অনেকখানি জায়গা ঘিরে মস্ত উঁচু পাঁচিল ছিল। কিন্তু এখন শুধু খানিকটা দাঁড়িয়ে আছে।
আমরা সেই খাড়া পাঁচিলের পাশ দিয়ে মাঠের মতো একটা খোলা জায়গায় ঢুকলাম। জেকব তার নোটবই বের করে দেখে নিল। তারপর ফিতে ফেলে কিছুদূর মাপজোক করল। এবার সে মনের আনন্দে টুপিটা খুলে ফেলল। তারপর আদিবাসীদের একটা বিশেষ জায়গা খুঁড়তে বলল।
আমি তো কিছুই ভেবে পাচ্ছিলাম না। এ তো সমতল জায়গা। কবরের চিহ্নমাত্র নেই। এখানে খুঁড়ে কি লাভ?
ততক্ষণে আদিবাসীরা গাঁইতি চালাতে আরম্ভ করেছে।
প্রায় তিন ঘণ্টা ধরে চলল খোঁড়া। অনেকখানি জায়গা জুড়ে একটা বিশাল গর্ত হলো। চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ল ধুলো আর ইটের টুকরো।
জেকব কয়েকটা ভাঙা ইট কুড়িয়ে নিয়ে পরীক্ষা করল। তারপর আদিবাসীদের হাতে কতকগুলো টাকা গুঁজে দিয়ে বলল, আরও টাকা পাবে। গভীর করে খোঁড়ো।
ঝপাং ঝপাং করে গাঁইতির ঘা পড়তে লাগল। একটা মানুষের মতো গভীর গর্ত তৈরি হলো। জেকব সেই গর্তের মধ্যে নেমে পড়ল। কিন্তু প্রতিমুহূর্তেই আমার ওপর ওর সতর্ক দৃষ্টি।
আরো জোরে গাহাত চালাও।
আদিবাসীরা টাকার লোভে জীবন পণ করে গাঁইতি চালাতে লাগল।
এবার মাটি অনেক ঢিলে। গাঁইতির এক এক ঘা পড়ে আর হুড়মুড় করে ইট-মাটির চাঙড় ভেঙে পড়ে। সঙ্গে সঙ্গে কোদালে করে সেগুলো তুলে বাইরে ফেলে দিতে লাগল।
এখন স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে ভেতরটা ফাঁকা। ওখানে কিছু আছে।
লক্ষ্য করলাম আদিবাসীদের গাঁইতি চালানো যেন আস্তে আস্তে ঝিমিয়ে আসছে। ওরা কি ক্লান্ত হয়ে পড়ছে?