একবার ভাবলাম জেকবকে ডেকে জিগ্যেস করি। কিন্তু ওর সঙ্গে কথা বলতে প্রবৃত্তি হলো না।
মরুক গে যাক বলে আবার শুয়ে পড়লাম। আজানের ধ্বনিও হঠাৎ থেমে গেল।
সঙ্গে সঙ্গেই চমকে উঠলাম, ঘোড়ার খুরের শব্দ! দুএকটা নয়, কয়েক শো ঘোড়া যেন ছুটে আসছে, খটা খট খটা খট করে। এই গভীর রাত্রে কোথা থেকে যে এত ঘোড়া আসছে ভেবে পেলাম না। তারপরেই শুনলাম চারপাশের প্রান্তর জুড়ে ঘোড়াগুলোর দাপাদাপি সেই সঙ্গে তরোয়ালের ঝনঝনা।
আমি আর শুয়ে থাকতে পারলাম না। উঠে দরজার কাছে গেলাম। আদিবাসীদের ঘরে বড়ো একটা জানলা থাকে না। তারা নাকি মনে করে অশুভ আত্মারা জানলা দিয়ে ঘরে ঢুকে পড়ে। মোহন মাণ্ডির ঘরেও জানলা নেই। আমি দরজাটা একটু ফাঁক করে শব্দ লক্ষ্য করে তাকালাম। ঘুরঘুঁটে অন্ধকার। তার মধ্যে দিয়েই দৃষ্টি তীক্ষ্ণ করে তাকালাম। দেখলাম এক অবিশ্বাস্য দৃশ্য। গোটা প্রান্তর জুড়ে অসংখ্য ঘোড়ার কালো কালো ছায়া। তাদের পিঠে এক একটা কালো কালো মূর্তি। সারা মাঠ জুড়ে তারা দাপাদাপি করছে।
তাড়াতাড়ি দরজা বন্ধ করে শুয়ে পড়লাম। কী অদ্ভুত ব্যাপার দেখলাম! এ সবই কি চোখের ভুল?
হঠাৎ দুটো ঘোড়ার খুরের শব্দ আমাদের ঘরের দিকে এগিয়ে এল। আমি ভয়ে কাঁটা হয়ে চোখ বন্ধ করে পড়ে রইলাম। ঘোড়া দুটো যেন কাছেই কোথাও এসে থামল। তারপরেই শুনলাম একটা মর্মান্তিক আর্তনাদ-জহরা অব্ হোনা, জহরা অব্ হোনা–আমি বিপদগ্রস্ত, স্পষ্ট মানুষের গলায়, আমি জালালুদ্দীনের পুত্র শামসুদ্দীন। আমাকে হত্যা করতে এসেছে। আমারই দুজন ক্রীতদাস। আমাকে বাঁচাও।
তারপরেই একটা অস্পষ্ট গোঙানি দুপুর রাতের বাতাসে মিশে গেল।
আমি নিঃশ্বাস বন্ধ করে পড়ে রইলাম। আর কোনো শব্দ নেই। মনে মনে ভাবতে লাগলাম এ রাত কি ভোর হবে না? এসব কী শুনলাম! সুলতান শামসুদ্দীনকে হত্যা করেছিল তারই দুই ক্রীতদাস। সে তো ১৪০০ খ্রিস্টাব্দের মাঝামাঝি সময়ের কথা! এত বছর পর আজ সেই শামসুদ্দীনের মৃত্যুভয়ে আড়ষ্ট গলা শুনলাম! এইরকম গভীর কোনো রাতে তার দুই বিশ্বস্ত ক্রীতদাস কি ঘোড়ায় চড়ে এসে তাকে খুন করে গিয়েছিল?
ছোটিবাবু!
চমকে উঠলাম। একেবারে ঠিক দরজার বাইরে কে যেন ডাকল।
ছোটিবাবু বলে কে কাকে ডাকল?
একটু পরে আবার সেই থমথমে গলা, ছোটিবাবু!
আমাদেরই কাউকে কেউ ডাকছে।
কিন্তু কে ডাকছে?
বরাবরই আমার খুব সাহস। কিন্তু ক্ষেত্র বিশেষে খুব সাহস যে ভালো নয় তা তখনও বুঝিনি।
আমি উঠে দরজার কাছে গিয়ে দাঁড়ালাম। কিন্তু তখনই দরজা খুললাম না। অপেক্ষা করে রইলাম আবার কেউ ডাকে কিনা শোনার জন্যে।
একটু পরেই আবার সেই গলা। এবার খুব কাছে। মনে হলো যে ডাকছে সে দরজার বাইরেই দাঁড়িয়ে আছে। এবার আমি নিঃশ্বাস বন্ধ করে দরজাটা খুলে ফেললাম। সঙ্গে সঙ্গে একটা ঠান্ডা বাতাস গায়ে ছুঁচের মতো বিধল।
কিন্তু
কিন্তু কই? কেউ তো নেই?
কী করব ভেবে না পেয়ে আমি একবার এদিক-ওদিক দেখে নিলাম।
না, কেউ নেই।
হঠাৎ আবার সেই কণ্ঠস্বর, ছোটিবাবু!
এবার যেন একটু দূরে।
আমি মন্ত্রমুগ্ধের মতো সেই স্বর লক্ষ্য করে অন্ধকারের মধ্যে এগিয়ে চললাম।
অন্ধকার, শুধু অন্ধকার। জীবনে অন্ধকার ঢের দেখেছি, কিন্তু ওরকম নিচ্ছিদ্র অন্ধকার কখনো দেখিনি। এক হাত দূরেরও কিছু দেখা যায় না। অন্ধ যেভাবে হাঁটে আমি সেইরকমভাবে অনিশ্চিতের পথে এগিয়ে চললাম। মাঝে মাঝে শুধু সেই কণ্ঠস্বর–ছোটিবাবু!
এগিয়ে চলেছি অন্ধকারে সাঁতার কাটতে কাটতে। কিছুক্ষণ আগেও যেখানে এত ঘোড়ার খুরের শব্দ শুনেছিলাম–অস্ত্রের ঝনঝনা শুনেছিলাম, কোন ভোজবাজির মতো সব থেমে গেছে। তবে কি সবই মনের ভুল? তাই যদি হয় তাহলে এই যে নিশুতি রাতে অন্ধকারের মধ্যে এগিয়ে চলেছি, এও কি মনের ভুল?
হঠাৎ মনে হলো কে যেন আমার গায়ের ওপর গরম নিঃশ্বাস ফেলল। আমি চমকে উঠলাম। তারপরেই মনে হলো কেউ যেন আমার পাশ দিয়ে দৃপ্তভঙ্গিতে হেঁটে গেল। কিন্তু কাউকে দেখতে পেলাম না।
এক জায়গায় এসে থমকে দাঁড়িয়ে পড়লাম। সামনে উঁচুমতো ওটা কী একটা একঠেঙে দৈত্যের মতো দাঁড়িয়ে রয়েছে?
ঠাওর করে দেখলাম।
আরে! এ তো ফিরোজ মিনার।
এতদূরে এলাম কি করে? কে আমাকে এখানে ডেকে আনল? কেন আনল? যে ডেকে আনল সে গেলই বা কোথায়?
হঠাৎ হু হু করে একটা বাতাস মিনারে ঠোক্কর খেয়ে আমার দিকে এগিয়ে এল। আমার সারা গা কাটা দিয়ে উঠল। আর তখনই যে দৃশ্যটা দেখে আমি চমকে উঠলাম তা বোঝানো কঠিন। স্পষ্ট দেখলাম বুড়ো মতো লুঙ্গি করা একটা লোক মিনারের গা বেয়ে টিকটিকির মতো তরতর করে একেবারে গম্বুজের মাথায় উঠে গেল আর তারপরেই
ইস! কেউ যেন তাকে পেছন থেকে ঠেলে ফেলে দিল।
ধড়াস করে কী যেন পড়ল আমার পায়ের কাছে। একটা মানুষের ঘেঁৎলানো দেহ। সর্বাঙ্গ থরথর কেঁপে উঠল। আর তখনই কে যেন খুব কাছ থেকে ডাকল, ছোটিবাবু!
দেখলাম আমার সামনে হাত দশেক দূরে যেখানে রাজমিস্ত্রির দেহটা আছড়ে পড়েছিল সেখানে দাঁড়িয়ে আছে কালকের সেই গাইড। পরনে কালো লম্বা আলখাল্লা। গলায় চকচকে নানারকম পাথরের মালা। লম্বা চুল পিঠ পর্যন্ত ঝুলছে। সব কিছু কালোর মধ্যে সাদা ধবধবে দাড়ি বাতাসে উড়ছে। হাতে একটা লোহার চিমটে।