জেকব তাকে ভেঙচে উঠে বলল, তোমার বিদ্যের দৌড় বোঝা গেছে। এবার কেটে পড়ো। এই নাও, বলে একটা টাকা ওর দিকে ছুঁড়ে দিল।
জেকবের ব্যবহার আমার যে কী খারাপ লাগছিল তা লিখে বোঝাতে পারব না।
গাইড মুখে কিছু বলল না। শুধু কেমন একরকম ভাবে জেকবের দিকে তাকাল। তারপর হুঁশিয়ার বাবুসাব, হুঁশিয়ার বলে হন হন করে এগিয়ে গেল। টাকাটা ছুঁলও না।
হঠাৎ মাথার ওপর বিকট একটা শব্দ কাঁ-কা-কা। চমকে তাকিয়ে দেখি একটা কাক মাথার ওপরে ঘুরপাক খাচ্ছে।
আরে সেই কাকটাই তো!
কাকটা এবার জেকবের মাথা লক্ষ্য করে ঠোঁট উঁচিয়ে নেমে এল। স্পষ্ট দেখলাম কাকটার বুকে ছোটো ছোটো সাদা দাগ। বোধহয় গুলির দাগ।
জেকব তখনই রিভলভার বের করে কাকটাকে মারতে যাচ্ছিল, দূরে দাঁড়িয়ে গাইড হেসে বলল, আপনার গুলিতে কোনো কাজ হবে না বাবু। ওটা পকেটে ঢুকিয়ে রাখুন।
বলেই ডান হাতটা তুলে একবার শূন্যে ঘোরাল। সঙ্গে সঙ্গে কাকটা দূর আকাশে উড়তে উড়তে অদৃশ্য হয়ে গেল।
এই যেসব ঘটনা দেখলাম, ডায়েরি লিখতে লিখতে তা মনে করে স্তম্ভিত হয়ে যাচ্ছি। এখন তো ১৯৩৫ সাল। ইংরেজ আমল। এই যুগেও এমন সব অসম্ভব অলৌকিক ঘটনা ঘটে। কাকটা তো বটেই, কিন্তু ঐ ফকিরই বা কে? তার হাতের ইশারাতেই কাকটা চলে গেল! তা ছাড়া কেনই বা সে জেকবকে বলে গেল–হুঁশিয়ার!
এখনও কিছুই বুঝতে পারছি না।
.
গভীর রাতের বিভীষিকা
৭ মার্চ বেলা দুটো
ফিরোজ মিনার দেখে ঐখানেই বসে আমরা দুপুরের খাওয়া সেরে নিলাম। মালদা থেকে লুচি, তরকারি আর মিষ্টি আনা হয়েছিল। রাতের খাওয়ার ব্যবস্থা অবশ্য আদিবাসীটির ঘরে। জেকব মুর্গির টাকা আগাম দিয়ে দিয়েছে।
খাওয়া শেষ হলে রুমালে মুখ মুছতে মুছতে জেকব বলল, তোমার সঙ্গে এবার কয়েকটা কথা স্পষ্টাস্পষ্টি বলে নিই।
ওর কথা বলার সুরে আমার বুকটা কেঁপে উঠল।
ও বলতে লাগল–তের বার আমি এখানে এসেছি শুধু গৌড় দেখবার জন্যে নয়। আমি অনেক পুরনো বই খুঁজে খুঁজে পড়েছি। অনেক সুলতানের কবরের কথা পেয়েছি। কিন্তু ফিরোজ শাহের কবরের কথা পাইনি। কোনো কোনো বইয়ে ফিরোজ শাহের কথা থাকলেও তা বিভ্রান্তিকর। এখানকার গাইডরাও সঠিক জানে না কোনটা আসল ফিরোজ শাহের কবর। মৃতের পরিচয় লেখা থাকে যে সব পাথরে, যাকে বলে স্মারকপ্রস্তর, তা এই প্রায় পাঁচশ বছরে ভেঙে পড়ে গেছে। কাজেই প্রকৃত ফিরোজ শাহের কবর কোনটি কেউ তা স্পষ্ট করে বলতে পারে না। কিন্তু আমি খুব পুরনো দুটো ফারসী বইয়ে সেই কবরের হদিস পেয়েছি। তার নকশাও করে এনেছি। খেয়ালী সুলতান নিজেই নিজের কবরগৃহ করে গিয়েছিলেন এক গোপন জায়গায়। কথাটা শুনে রাখ শুধুই কবর নয়–কবরগৃহ। সেখানেই রয়েছে সুলতানের দেহ আর তার প্রচুর ঐশ্বর্য–যেমন মিশরে সম্রাটদের মমির সঙ্গে রাখা হতো।
আমি সেই ঐশ্বর্যের লোভেই এবার এসেছি। তোমাকে এনেছি আমার স্বার্থে। তুমি আমাকে সাহায্য করবে। কেন না ঐ ঐশ্বর্য একা উদ্ধার করা আমার একার সাধ্য নয়। বুঝেছ?
আমি রাগে দুঃখে ভয়ে চুপ করে রইলাম। হায়! শেষ পর্যন্ত একটা চোরের সঙ্গে আমি এখানে এলাম!
চুপ করে থেকো না। জেকব চেঁচিয়ে উঠল। যা বলব তাই শুনবে। নইলে গুলি করে তোমায় মেরে এখানে পুঁতে রেখে যাব। কাক-পক্ষীতেও টের পাবে না। তারপর একটু থেমে বলল, আর যদি আমার কথা শোনো তাহলে যা পাব তার কিছু তোমাকে দেব। তাতে তোমার সারা জীবন ভালোভাবেই কেটে যাবে।
আমি বুঝতে পারছি আমি ঐ চোরটার হাতের মুঠোয় চলে গিয়েছি। আর নিষ্কৃতি নেই। আমি ওর কথামতো চললেও শেষ পর্যন্ত ও এই অপকর্মের সাক্ষীকে কিছুতেই বাঁচিয়ে রাখবে না।
তাহলে? কি করব এখন?
চোখে জল আসছে….আর লিখতে পারছি না।
.
৮ মার্চ সকাল ৮টা
গতকাল রাতে ডায়েরি লিখতে পারিনি। যে সব ঘটনা ঘটে গেল তা এতই অসম্ভব আর আকস্মিক যে কিছু লেখার মতো অবস্থা ছিল না। আজ কিছুটা ধাতস্থ হয়ে তারপর লিখছি।
কাল রাত নটার মধ্যে গরম গরম মুর্গির ঝোল আর ভাত খুব তৃপ্তির সঙ্গে খেয়ে শুয়ে পড়লাম। আদিবাসীদের মোড়ল বা সর্দার মাণ্ডির বৌ খুব চমৎকার মাংস বেঁধেছিল। ওরা থাকে পিছনের দিকে। খুবই গরিব। তাই জেকব টাকা দিয়ে এদের বশ করে নিয়েছে।
আমার আর জেকবের জন্যে পাশাপাশি দুটো দড়ির খাঁটিয়া। মশারি টাঙিয়ে শুয়ে পড়লাম। জেকবও শুয়ে পড়েছে। দুপুর থেকে এখনও পর্যন্ত আমার সঙ্গে একটি কথাও বলেনি। খুব গম্ভীর। বোধ হয় মতলব ভাজছে। এখান থেকে পালিয়ে যেতে পারলে বাঁচতাম। কিন্তু উপায় নেই। জেকব জানতে পারলে গুলি করে মারবে।
শরীরের দিক থেকে না হলেও মনের দিক থেকে খুব ক্লান্ত ছিলাম। সেই অদ্ভুত কাকটা, ঘোড়াটার থমকে দাঁড়িয়ে পড়া, বৃদ্ধ ফকির গাইডের কথা, ফিরোজ শাহের নির্মম ব্যবহার, গাইডের হুঁশিয়ারি, সবচেয়ে বেশি জেকবের শাসানি আমার মনটাকে ভেঙে দিয়েছিল। বড়ো অসহায়, বড়ো ক্লান্ত লাগছিল। তাই বিছানায় শোওয়ামাত্র ঘুমিয়ে পড়লাম।
রাত তখন কত জানি না হঠাৎ আজানের শব্দে ঘুম ভেঙে গেল। চারদিকে যত মসজিদ ছিল, সব জায়গা থেকেই আজানের ধ্বনি ভেসে আসতে লাগল। আমি শুয়ে শুয়েই টর্চের আলোয় রিস্টওয়াচটা দেখলাম। রাত দুটো। এত রাতে কেউ আজান দেয় নাকি? তা ছাড়া তা ছাড়া এখানে যতদূর ঘুরেছি কোথাও একটা আস্ত মসজিদ চোখে পড়েনি। সবই ধ্বংসস্তূপ। তা হলে আজান কে দিচ্ছে–কোথা থেকে দিচ্ছে?