আমি যখন অবাক হয়ে এইসব দেখছি, জেকব তখন মাটিতে বসে ব্যাগ থেকে খাতা পত্তর বের করে কী সব নকশা দেখছে।
সেলাম আলেকুম!
চমকে চেয়ে দেখি একমুখ পাকা দাড়ি আলখাল্লা পরা দীর্ঘকায় ফকিরের মতো একজন দাঁড়িয়ে আছে।
গাইড? ফকির বললে।
জেকব ভয়ানক বিরক্ত হয়ে বললে, না না, গাইডের দরকার নেই।
ফকির মিনতি করে বললে, সব ভাল করে দেখিয়ে দেব বাবু। যা খুশি তাই দেবেন।
বলছি তো গাইড লাগবে না। তুমি যাও এখন।
ফকির বললে, নিজেরা হয়তো ঘুরে ঘুরে সব দেখবেন। কিন্তু শুধু দেখে কি হবে? বহুৎ কহানী হ্যায়, যা আমি জানি, আপনারা জানেন না। কতজনের কত দুঃখ, চোখের জল, কত খুন…ফিরোজ মিনারের নাম শুনেছেন তো?
ফিরোজ নামটা শুনেই জেকবের দুচোখ ঝকঝক করে উঠল। ওর মাথায় বুঝি কোনো মতলব খেলল। উঠে দাঁড়িয়ে বলল, এখানে সুলতানদের কবরগুলো কোথায় আছে বলতে পার?
কত কবর চান? দিলীর খাঁর কবর, ফতে খাঁর কবর, সুলতান হোসেন শাহর কবর, নসরৎ শাহের কবর, তার ছেলেদের কবর, আরও কত খানদানি রাজপুরুষদের কবর। আরও পুরনো কবর যদি দেখতে চান তাহলে বাংলাকোট চলুন।
জেকব উৎসাহিত হয়ে বললে, তুমি আগে ফিরোজ মিনার চলো। সুলতান ফিরোজের কথা জানতে চাই।
বেলা বারোটা বাজে। আমরা দাখিল দরওয়াজাকে ডান দিকে রেখে চলেছি দক্ষিণমুখী। পাশে পরিখা আর গড়। গড়ে চাষ হচ্ছে। দেখলে মনে হয় কী শান্ত নিশ্চিন্ত জীবন!
ফকির তার আলখাল্লা পরা দীর্ঘ দেহ নিয়ে আগে আগে চলেছে আমাদের পথ দেখিয়ে। জেকবের সন্ধানী দৃষ্টি চারদিকে কী যেন খুঁজে বেড়াচ্ছে। একটু পরেই মিনারের মাথা দেখা গেল। আমরা মিনারটার সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম। গাইড যা বলল তা থেকে জানলাম মিনারটির নাম ফিরোজ মিনার। অনেকে মনে করেন এটি বিজয়স্তম্ভ, আবার অনেকের মতে এটি মোঝিনমঞ্চ। মোঝিনমঞ্চ মানে কী আমি তা জানি না। গাইডকে জিগ্যেস করার সময়ও পাইনি। ভয়, বেশি প্রশ্ন করলে জেকব হয়তো বিরক্ত হবে। লোকটাকে এখনও ঠিক বুঝতে পারছি না। মিনারটা অনেকটা দিল্লির কুতুব মিনারের মতো। তবে অত উঁচু নয়। পাঁচটি থাক। অর্থাৎ প্রায় পাঁচতলা। সবার ওপরে রয়েছে কারুকার্যময় গম্বুজ।
সবচেয়ে বড়ো আকর্ষণ মিনারটি নীল রঙের টালিতে গাঁথা। গাইড জানাল মিনারটি তৈরি করেছিলেন হাবসী বংশীয় সুলতান সৈফুদ্দীন ফিরোজ শাহ। ফিরোজ সাহ অত্যন্ত খেয়ালী ও জাঁকজমকপ্রিয় সুলতান ছিলেন। প্রচুর ঐশ্বর্য ছিল তাঁর।
জেকব এতক্ষণ অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে গাইডের কথাগুলো শুনছিল। যেন তার শোনার দরকার নেই। সবই সে জানে। প্রচুর ঐশ্বর্য, খেয়ালী আর জাঁকজমকপ্রিয় কথা তিনটে শুনে সে এবার গাইডের দিকে তাকাল।
আমি এমন বইও পড়েছি যাতে লেখা আছে সুলতান ফিরোজ শাহ নিজের কবরগৃহ কিরকম হবে, কি কি জিনিস দিয়ে সাজানো হবে তার ব্যবস্থা নিজেই করে গিয়েছিলেন। এ ব্যাপারে তুমি কিছু জান ফকির সাহেব?
গাইড মাথা নাড়ল–না।
তবে আর তুমি কি ছাই জান? বলে জেকব অবজ্ঞার দৃষ্টিতে গাইডের দিকে তাকাল।
গাইডের মুখটা অপমানে থমথম করতে লাগল। তবু সে তার কর্তব্য করল। ফিরোজ মিনার নিয়ে যে কিংবদন্তী আছে তা গড়গড় করে বলে গেল। কাহিনিটা এইরকম–
সুলতান ফিরোজ শাহর খেয়াল হলো অবিলম্বে খুব উঁচু একটা মিনার তুলতে হবে। তামাম গৌড়-সুলতানের কীর্তির মধ্যে যেটা শ্রেষ্ঠ দর্শনীয় বস্তু হয়ে থাকবে। আর মিনারের কারুকার্য হবে অসাধারণ।
সঙ্গে সঙ্গে নগরের শ্রেষ্ঠ রাজমিস্ত্রিকে ডাকা হলো। রাজমিস্ত্রি কাজে লেগে পড়ল। এক মাস যেতে না যেতেই সুলতান খবর নিতে পাঠান, কত দূর হলো?
এতো বড়ো মিনার তৈরি করা তো যাদুমন্ত্রের ব্যাপার নয়। সময় তো লাগবেই। কিন্তু অবুঝ অধৈর্য সুলতানের আর তর সয় না। কিসের এত তাড়া কে জানে!
শেষে একদিন রেগেমেগে তাঞ্জামে চড়ে লোকলস্কর নিয়ে নিজেই চলে এলেন। কাজ দেখে তিনি হতাশ হলেন। বড় ধীরে কাজ হচ্ছে।
কেন এত দেরি হচ্ছে? চিৎকার দিলেন সুলতান।
রাজমিস্ত্রি বোঝাতে চাইল, এসব কাজ তাড়াহুড়ো করে হয় না। যে জিনিস বহু যুগ ধরে কীর্তি হয়ে থাকবে তা তৈরি করার সময়ে যথেষ্ট সময় দিতে হবে।
সুলতান রাজমিস্ত্রির এই কৈফিয়তে খুশি হলেন না। তাঁর ভ্র জোড়া কপালে লাফিয়ে উঠল। দুচোখে ক্রোধের বহ্নিশিখা। তিনি হুকুম দিলেন, মিনার যতদূর উঠেছে সেখান থেকে ঐ অপদার্থটাকে ছুঁড়ে ফেলে দাও।
সঙ্গে সঙ্গে রাজমিস্ত্রিকে ওপরে টেনে নিয়ে গিয়ে মাটিতে ছুঁড়ে ফেলে দেওয়া হলো। তালগোল পাকিয়ে পড়ে রইল রাজমিস্ত্রির রক্তাক্ত দেহটা।
কতখানি উঁচু হয়ে উঠেছিল মিনারটা তখনই, মিস্ত্রির তালগোল পাকানো দেহটা নিঃশব্দে তা প্রমাণ করে দিল।
সুলতান কিন্তু এসব নিয়ে মাথা ঘামান না। আদেশ করলেন তখনই আরও ভালো রাজমিস্ত্রি নিয়ে আসতে।
এই হলো ফিরোজ মিনারের কাহিনি। কথা শেষ করে গাইড তার পাকা দাড়িতে হাত বোলাতে লাগল।
জেকব গাইডের কাছে এগিয়ে গিয়ে চাপা গলায় বলল, ফকির সাহেব, এই ফিরোজ শাহের কবরটা কোথায় বলতে পার? তোমায় অনেক টাকা দেব।
হঠাৎ গাইডের ভ্রূ জোড়া বেঁকে উঠল। কেন বলুন তো বাবু?
আমি সেই কবরে ঢুকব।
গাইড বলল, ওসব মতলব ছাড়ুন বাবুসাহেব। এইজন্যেই যদি এখানে এসে থাকেন তাহলে বহুৎ ভুল হবে। বাড়ি ফিরে যান।