নীলকুঠির ইংরেজরা এখানে রং তৈরি করত। তাই রং + ইংরেজ + বাজার = রংরেজবাজার হয়ে গিয়েছিল।
আমি নোট করে নিলাম।
এক্কা ছুটছে। খোয়া বের করা গৌড় রোডে একঘেয়ে শব্দ হচ্ছে খটাখট-খটাখট। মাঝে মাঝে খোলা মাঠের ওপর দিয়ে ঈষৎ গরম দমকা বাতাস ধুলো উড়িয়ে আসছে। বাতাসটা যেন কেমন! এ ধরনের বাতাসের সঙ্গে অন্তত আমার পরিচয় নেই। সকালে যে ফুরফুরে বাতাসে আরাম পাচ্ছিলাম, এখন সেই বাতাস আর নেই। এখন শুধু শরীরেই নয়, মনের ভেতরেও যেন কেমন অস্বস্তি হচ্ছে। মনে হচ্ছে আর গিয়ে কাজ নেই, ফিরে যাই। কেন যে এমন মনে হচ্ছে তা বুঝতে পারলাম না।
গৌড় আসতে আর মাত্র কয়েক মাইল। লক্ষ্য করলাম–ঘোড়াটার ছোটার গতি কমে আসছে। গাড়োয়ান বুঝতে পারছে না। সে কেবল চাবুক কষাচ্ছে।
শেষে ঘোড়াটা চিঁহি চিহি করে ডাকতে ডাকতে একেবারে দাঁড়িয়ে পড়ল। কিছুতেই আর তাকে নড়ানো গেল না।
গাড়োয়ান গাড়ি থেকে নেমে ঘোড়াটাকে দেখল। না, কোনো অসুখ করেনি। তেমন ক্লান্তও নয়। তাহলে আর যেতে চাইছে না কেন?
গাড়োয়ান অনেক চেষ্টা করল। কিন্তু ঘোড়া আর নড়ল না।
গাড়োয়ান তখন নিরুপায় হয়ে বলল, বাবু, ঘোড়া তো আর যেতে চাচ্ছে না।
কেন? বিরক্ত হয়ে জিগ্যেস করল জেকব।
কী জানি। বুঝতে পারছি না। এর আগেও তো ঢের সওয়ার এনেছি। এমন হয়নি।
তারপরই হঠাৎ ওর কি মনে হলো। বলল, বাবু, হাওয়াটা আজ বড্ড ভারী। আপনারাও না হয় নাই গেলেন।
কেন? ফের জিগ্যেস করল জেকব।
গাড়োয়ান ইতস্তত করে বলল, যেখানে যাচ্ছেন সে জায়গাটা তো ভাল নয়। সুলতানদের আমলে কত খুন-জখম হয়েছে। ওখানে তো কবরের পর কবর। তেনারা তো আজও আছেন। ঘুমিয়ে থাকেন। জেগে উঠলে আর রক্ষে নেই।
যত বোগাস কথা! বলে বিরক্ত জেকব চুরুট ধরাল।
তাহলে আমাদের উপায়?
একান্তই যখন যাবেন তখন এ পথটুকু হেঁটেই চলে যান। ঐ তো পিয়াসবারি দীঘি দেখা যাচ্ছে। ঐখান থেকেই তো গৌড়ের শুরু।
তাকিয়ে দেখলাম বহুদূরে অনেকখানি জায়গা জুড়ে জলের মতো কি যেন চিকচিক করছে।
.
ফকির সাহেব
৭ মার্চ বেলা ১১টা
আরও একটা মুশকিল হয়েছে। গাড়োয়ানকে বলা হয়েছিল গৌড়ে দুতিন দিন থাকতে হবে। এর জন্যে ওকে মোটা রকম টাকা দেওয়া হবে। ওকে থাকতে বলার কারণ গৌড় থেকে ফেরার জন্যে কোনোরকম গাড়ি পাওয়া যায় না। গাড়োয়ান টাকার লোভে রাজি হয়েছিল। কিন্তু ঘোড়াটা ঐরকম বিগড়ে যাওয়ায় গাড়োয়ান কিছুতেই থাকতে চাইল না। আরও আশ্চর্যের ব্যাপার, এক্কার মুখ মালদার দিকে ফেরাতেই ঘোড়া দিব্যি ছুটতে লাগল।
জেকবের দিকে তাকিয়ে দেখি ও খুব চিন্তান্বিত। জিগ্যেস করলাম, কি ভাবছেন?
কিছু না। হাঁটো।
হাঁটতে হাঁটতে আমরা সেই পিয়াসবারির কাছে এসে পৌঁছলাম। স্বচ্ছ টলটলে জল। আমরা দীঘির পাড়ে গিয়ে বসে একটু বিশ্রাম করলাম।
কী চমৎকার জল, না?
জেকব একটা চুরুট ধরিয়ে হেসে বলল, হ্যাঁ, খুবই ভাল জল। নাম পিয়াসবারি।
একটু থেমে বলল, তা বলে খেও না যেন।
কেন?
আবুল ফজল তার আকবরনামায় একটা কিংবদন্তীর কথা লিখেছেন। কিংবদন্তীটি অনুয়ায়ী এই যে জল দেখছ এটা বিষাক্ত। মোগল আমলে মৃত্যুদণ্ডের আসামীদের কয়েক দিন ধরে জল খেতে দেওয়া হতো না। তারপর যখন তেষ্টায় বুক ফেটে যেত, যখন জল জল করে চিৎকার করত তখন তাদের এই দীঘির ধারে এনে ছেড়ে দেওয়া হতো। এই টলটলে জল দেখে তারা উন্মাদ হয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ত জলে। অঞ্জলি ভরে জল খেত। কিন্তু তারপরেই তারা মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ত।
ইস! চমকে উঠলাম আমি। এই জল কি এখনও বিষাক্ত?
বলতে পারি না। খেয়ে দেখিনি। তবে আকবর নাকি ঐ নিষ্ঠুর প্রথা বন্ধ করে দিয়েছিলেন।
আমি কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলাম দীঘিটার দিকে। দীঘির পাড়ের গাছগুলো যেন কেমন শুকনো শুকনো। গরু ছাগল চরছে বটে কিন্তু তাদের জল খেতে দেখলাম না।
বোতল থেকে ঢকঢক করে জল খেয়ে আমরা উঠে পড়লাম।
সেখান থেকে কাছেই আদিবাসীদের গ্রামে নিয়ে চলল জেকব। তেরবার এখানে এসেছে। অনেক আদিবাসীদের সঙ্গেই চেনাজানা অছে। আদিবাসীদের মাতব্বরকে কিছু টাকা দিয়ে আড়ালে তার সঙ্গে কী সব কথা বললে। দুদিনের জন্যে থাকারও ব্যবস্থা হলো। কিন্তু আমি লক্ষ্য করলাম আদিবাসীরা জেকবকে দেখে খুশি হলো না।
পিয়াসবারি থেকে গৌড়পথ সোজা এগিয়ে গেছে। ঐ পথ থেকে ডান দিকে আর একটি রাস্তা চলে গেছে। এরই মুখে রামকেলী গ্রাম। বৃন্দাবন যাবার পথে এখানে এসেছিলেন মহাপ্রভু শ্রীচৈতন্যদেব। এখানেই তার সঙ্গে দেখা করতে এসেছিলেন সুলতান হোসেন শাহের দুজন মন্ত্রী দবির খাস ও সাকর মল্লিক। শ্রীচৈতন্যদেবের পুণ্যস্পর্শে মন্ত্রীরা হয়ে গেলেন পরম বৈষ্ণব। নতুন নাম হলো তাদের রূপ ও সনাতন গোস্বামী।
আমরা এগিয়ে চলেছি। জেকব অন্যমনস্ক। তবে আমার প্রতি সদয়। জিগ্যেস করলে মাঝে মাঝে উত্তর দিচ্ছে। এইভাবেই দেখলাম মদনমোহন জীউ-এর মন্দির, সনাতন গোস্বামীর প্রতিষ্ঠিত শ্যামকুণ্ড, রাধাকুণ্ড, ললিতাকুণ্ড, বিশাখাকুণ্ড। দেখলাম রূপ গোস্বামীর তৈরি রূপসাগর। তারপরেই দক্ষিণে কিছুদূর দিয়ে থমকে দাঁড়িয়ে পড়লাম। বিশাল এক ভগ্ন প্রাসাদ। এইটিই ইতিহাস-বিখ্যাত বারদুয়ারী।
এর একটু দূরেই দাঁড়িয়ে আছে খুব উঁচু প্রাচীর। এর নাম দাখিল দরওয়াজা। শাহী নগরকেন্দ্রের অর্থাৎ রাজবাড়ি প্রবেশের উত্তর দরজা ছিল। বিশাল সে দরজা। অবাক হয়ে দেখতে হয়। ঐ দরজার মাথায় দাঁড়িয়ে গৌড়ের সুলতানরা বিজয়ী সৈনিকদের অভিবাদন গ্রহণ করতেন কান-ফাটানো তোপধ্বনির সঙ্গে।