একজন দোকানদারকে বলতেই সে একটা হোটেলের ঠিকানা দিল। হোটেলটা গোলাপট্টিতে। বিহারী ঠাকুরদের হোটেল। নতুন হয়েছে। এখানে সবচেয়ে পুরনো হোটেল কালীর থানের উত্তর দিকে। সেখানেও জায়গা ছিল। কিন্তু পছন্দ হলো না জেকবের।
.
৭ মার্চ
এখানে আসতে বেশ ধকল গিয়েছিল। তাই জেকব যখন বললে, একটা দিন রেস্ট নাও, তখন খুব খুশি হলাম। কিন্তু সে নিজে রেস্ট নিল না। চা খেয়েই বেরিয়ে গেল, ঘণ্টা চার পরে ফিরল। বললাম, কোথায় গিয়েছিলে?
উত্তরটা এড়িয়ে গিয়ে শুধু বলল, এই একটু
ওর এড়িয়ে যাওয়াটা আমার ভালো লাগল না। বুঝলাম বয়েসে কম বলেই আমকে উপেক্ষা।
মরুক গে। নতুন জায়গা দেখব বলে এসেছি। সেটুকু দেখা হলেই আমি খুশি।
সকালেই চা, টোস্ট আর ডিমের ওমলেট খেয়ে কাঁধে ব্যাগ ঝুলিয়ে নিলাম। জেকবের পরামর্শে একটা ওয়াটার-বটল কিনে নিয়েছি। জেকব বললে, ওখানে খুব জলকষ্ট। কাছাকাছি এমন কোনো গেরস্থালি নেই যে জল চেয়ে পাওয়া যাবে।
এতক্ষণে জিগ্যেস করতে সাহস পেলাম, আমরা এখন কোথায় যাচ্ছি?
উত্তরে সংক্ষেপে বললে, গৌড়।
আর পাণ্ডুয়া?
জেকব তখনই উত্তর দিল না।
বুঝলাম প্রশ্ন করাটা পছন্দ করছে না।
একটু পরে বলল, যদি দরকার বুঝি তাহলে অন্য দিন। গৌড়-পাণ্ডুয়া একসঙ্গে আমরা বলি বটে কিন্তু গৌড় একদিকে, পাণ্ডুয়া অন্যদিকে।
আমি সত্যিই বোকা, তাই একটু আগেই ধমক খেয়েও ফের প্রশ্ন করলাম, আচ্ছা মালদহর নাম কি ইংরেজবাজার?
উত্তরে জেকব শুধু বললে, গাড়িতে উঠে পড়ো।
ব্যস। আর কথা নয়। গাড়িতে উঠে পড়লাম।
গাড়ি মানে এক্কাগাড়ি। এক ঘোড়ার এক্কাগাড়ি। আগেই ঠিক করে রাখা হয়েছিল। উঠে বসতেই গাড়ি ছেড়ে দিল।
সময়টা মার্চ মাস। অর্থাৎ ফাল্গুন মাস। শীত নেই। গরমের কষ্টও নেই। আকাশ পরিষ্কার।
সকাল সাতটায় এক্কা ছাড়ল। বেশ তেজী ঘোড়া। মালদহ ছাড়ার একটু পরেই মকদুমপুরে একটা শিবমন্দিরের কোল ঘেঁষে যে রাস্তাটা মোচড় খেয়ে সোজা দক্ষিণে চলে গেছে, সেই দিকে আঙুল তুলে জেকব বলল, ঐ যে শিবমন্দির, ওটা প্রতিষ্ঠা করেছিলেন জনৈক রাজা রায়চৌধুরী। এই রাস্তাটার নাম গৌড় রোড। কোম্পানির আমলে এর নাম ছিল নবাবগঞ্জ রোড। আবার নবাব বা সুলতানী আমলে ছিল শাহী সড়ক। আমি তখনই তা নোট করে নিলাম। মনে মনে খুশি হলাম, জেকব অনুগ্রহ করে মুখ খুলেছে।
বেশ যাচ্ছিলাম। সকালের রোদটি মিষ্টি লাগছিল। দুপাশে ধু ধু প্রান্তর। ঝিরঝিরে হাওয়া। জানলাম গৌড়-নগরে ঢুকতে খুব দেরি নেই। পুরনো গড় পার হলেই গৌড় দর্শন শুরু হবে।
এই সময়ে উটকো একটা বিপত্তি শুরু হলো। কোথা থেকে একটা কাক উড়ে এসে আমাদের মাথার ওপর চক্কর কাটতে লাগল। আর বিকট শব্দে ক্যা-ক্যা করতে লাগল।
কাক যে অত বড়ো হয় জীবনে কখনো দেখিনি। পাহাড়ের দেশ হলেও না হয় কথা ছিল। কিন্তু এ তো একেবারে আমাদের সুজলা সুফলা বাংলাদেশ। শুধু বিরাট আকারই নয়, ডাকটাও ভয়ঙ্কর। চোখ দুটো ঘুরছে। মনে হচ্ছিল এখনই ঠোঁট দিয়ে ঠোক্কর মারবে।
গাড়োয়ান দুবার চাবুক তুলে শূন্যে ঘোরাল। কাকটা পালাল বটে কিন্তু একটু পরেই আবার তেড়ে এল।
এ তো আচ্ছা জ্বালা হলো!
কাকটা এবার জেকবের মাথার কাছে ঘুরতে লাগল। জেকব মুখ তুলে ভুরু কুঁচকে কাকটার দিকে তাকাল। কাকটা পালিয়ে গেল।
জোরসে হাঁকাও। জেকব গাড়োয়ানকে হুকুম করল। গাড়োয়ান জোরে চাবুক কষাল ঘোড়াটার পিঠে।
কেন যে জেকব জোরসে হাঁকাতে বলল, কেনই বা গাড়োয়ান গাড়ি ছুটিয়ে দিল তার কারণ বুঝতে পারলাম না। সামান্য কাকের ভয়ে?
কাকটা বোধহয় সামান্য ছিল না। হঠাৎ ঘোড়াটা চিহি চিহি করে ডেকে উঠল। সঙ্গে সঙ্গে দেখা গেল সেই বিকটাকার কাকটা জেট বিমানের মতো ডাইভ দিয়ে জেকবের মাথার ওপর নেমে আসছে।
এবার জেকব যা করলে তা ভাবতেও পারিনি। হঠাৎ পকেট থেকে রিভলভার বের করে কাকটাকে লক্ষ্য করে দুবার গুলি ছুড়ল। আমি স্বচক্ষে দেখলাম দুটো গুলিই কাকটার পেটে লাগল। কিন্তু কাকটা মরল না। এক ফোঁটা রক্তও পড়ল না। দিব্যি উড়ে পালাল।
আমারই মতো জেকব অবাক হয়ে উড়ন্ত কাকটার দিকে তাকিয়ে রইল। গাড়োয়ান ফিরেও তাকাল না। সে জোরে গাড়ি ছোটাচ্ছে, যেন তাড়াতাড়ি জায়গাটা পার হতে পারলে বাঁচে।
আমি দুটো জিনিস ভেবে অবাক হলাম–দুদুটো গুলি খেয়েও কাকটা উড়ে পালাল কি করে? আর জেকব সঙ্গে রিভলভার রাখে! এ তো তাহলে সোজা লোক নয়।
আমাকে হতভম্ব হয়ে থাকতে দেখে পরিস্থিতি স্বাভাবিক করার জন্যে জেকব আমার দিকে তাকিয়ে একটু হেসে চুরুট ধরিয়ে বলল, ভয় কি? আমি তো আছি।
হঠাৎ জেকব ভয়ের কথা কেন বললে তা বুঝতে পারলাম না। সত্যি বলতে কি আমি তো ভয় পাইনি। ভয়ের তো কোনো ঘটনা ঘটেনি। আমি শুধু অবাক হয়েছিলাম কাকটা দুদুটো গুলি খেয়েও মরল না দেখে।
এক মুখ ধোয়া ছেড়ে জেকব সহজভাবে বললে, তখন তুমি কী যেন জানতে চাইছিলে? ও হ্যাঁ, মালদারই নাম ইংরেজবাজার কিনা। শুনে রাখো ইংরেজরা এদেশে আসার পর মহানন্দা নদীর পশ্চিম পাড়ের জমি কোনো এক রাজা রায়চৌধুরীর কাছ থেকে মাত্র তিনশো টাকায় কিনে নেয়। সেখানে ১৬৮২ খ্রিস্টাব্দে তারা ইংলেজাবাদ শহর গড়ে তুলল মোঘলদের অনুকরণে। ১৭৭১ খ্রিস্টাব্দে গড়ল ইংরেজবাজার। সাধারণ লোকের মুখে মুখে কথাটা দাঁড়াল ইংলেজাবাদ। কথাটা আসলে ইংরেজবাজার। এরই নাম মালদহ।