শুধু হাড় আর ছাই? ওতে আমি ইন্টারেস্টেড নই। আমি চাই কফিনের মধ্যে রাজা রাজড়াদের বড়ি–ডেডবডি।
বলতে বলতে জেকবের দুচোখ ঝকঝক করে উঠল, সেরকম কিছু আছে? মাথা নাড়লাম। বললাম না।
জেকব যেন আমার কথায় হতাশ হলো। এইভাবেই জেকবের সঙ্গে আমার প্রথম আলাপ। কথায় কথায় জেকব জানাল, দুদিন আগে সে এখানে এসেছে। উঠেছে একটা হোটেলে। এর মধ্যে পুরনো মন্দির, মসজিদগুলো দেখে নিয়েছে। এখন ঘুরতে ঘুরতে এই নদীর ধারে এসেছে। আমি সেই ইটের সারগুলো দেখিয়ে বললাম, এগুলো কি বলতে পারেন সাহেব?
জেকব দুএকটা ভাঙা ইট পরীক্ষা করে বলল, মনে হচ্ছে কোনো রাজবাড়ির ভাঙা পাঁচিল।
নো-নো সাহেব, এগুলো হচ্ছে নীল চাষের জায়গা। আগে ইটের বড়ো বড়ো চৌবাচ্চা করে নীল গাছ ভিজিয়ে রাখা হতো। নীলকর সাহেবরা আমাদের দেশের গরিব চাষীদের ওপর কত যে অমানুষিক অত্যাচার করেছে তা জান না?
জানি, জানি। শুধু জানতাম না তোমাদের কালনাতেও নীলচাষ হতো।
এরপর আরও দুদিন জেকব আমাকে সঙ্গে নিয়ে ঘুরল। আমার সৌভাগ্য, আমাকে ওর খুব ভালো লেগেছে। তারপরই সে আমায় সেই লোভনীয় প্রস্তাবটা দিল। বলল, মালদা গিয়েছ? গৌড়-পাণ্ডুয়া দেখেছ?
বললাম, না।
সে কী! গৌড়-পাণ্ডুয়া না দেখলে বাংলার সুলতানদের ইতিহাস জানা যায় না। সারি সারি ধ্বংসাবশেষের মধ্যে এখনও লুকিয়ে আছে কত ঐশ্বর্য সে তুমি না দেখলে ভাবতে পারবে না।
আমি বললাম, আপনি গৌড়-পাণ্ডুয়া গিয়েছেন?
জ্বলন্ত চুরুটটা দাঁত থেকে সরিয়ে জেকব হেসে বললে, এক-আধবার নয়, থার্টিন টাইমস।
এত বার গিয়েও আবার যাবেন?
হ্যাঁ। তার কারণ আমি শুধু টুরিস্টদের মতো চোখের দেখা দেখি না। আমি কিছু খুঁজে বেড়াই।
কী খোঁজেন?
তা আমি এখন বলব না। তুমি যাবে আমার সঙ্গে?
আমি সানন্দে বলে উঠলাম, নিশ্চয় যাব।
তবে একটা কথা, আমি যেখানে যেখানে যাব, যা যা করব তা শুধু তুমি দেখে যাবে। কোনো কিছু জিজ্ঞেস করতে পারবে না। আর কাউকে কোনো দিন বলবে না।
ঠিক আছে।
আর আমার সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করলে ফল খারাপ হবে মনে রেখো।
বললাম, ঠিক আছে।
তা হলে কালনায় আর থেকে লাভ নেই। কালই বেরিয়ে পড়ব।
কোথায় যাব প্রথমে?
মালদা। সেখান থেকে গৌড়-পাণ্ডুয়া। তারপর একটু থেমে বলল, মালদহ নাম কেন বলতে পার?
মাথা নাড়লাম।
জেকব বলল, কেউ কেউ বলেন মলদ নামে একটি ট্রাইব বা সম্প্রদায় ছিল। ঐ মলদ থেকে নাম হয়েছে মালদহ। আবার কেউ কেউ বলেন, ফারসী মাল আর বাংলা দহ এই দুই শব্দ মিলে হয়েছে মালদহ। মাল শব্দের মানে ধনদৌলত। দহ শব্দের মানে সাগর। তাই মালদহের মানে ধন-সাগর। এই নামই বুঝিয়ে দেয় মালদহের মধ্যে প্রাচীন ঐশ্বর্য এখনও কত লুকিয়ে আছে।
বলতে বলতে জেকবের দুচোখ লোভীর মতো চকচক করে উঠল।
আমার সেটা ভালো লাগল না। যারা টুরিস্ট, যারা প্রত্নতত্ত্ববিদ, যারা মাটি খুঁড়ে প্রাচীন ইতিহাস খুঁজে বেড়ায়, ধন-ঐশ্বর্যের কথায় তারা এমন লুব্ধ হবে কেন?
যাই হোক পরের দিনই আমরা মালদা রওনা হলাম।
.
কাকদর্শন
আজ এই ১৯১৯ সালে যাঁরা গৌড়-পাণ্ডুয়া দেখতে যাবেন তারা কল্পনাও করতে পারবেন না সেই ১৯৩৫ সালে সেখানকার অবস্থা কিরকম ছিল।
চারদিক ফাঁকা। এদিকে-ওদিকে ধু ধু মাঠ। দুধারে বাবলা গাছ। কোথাও বা আমবাগান। কঁচা ধুলোভরা রাস্তা জনমানবশূন্য। মাঠের ওপর দিয়ে দুপুরবেলা হু হু করে গরম বাতাস বয়। মনে হয় যেন কত যুগের মৃত, ক্ষুব্ধ আত্মারা দীর্ঘশ্বাস ফেলছে। যেন বলছে, আর ওদিকে এগিয়ো না। ওখানে শুধু এখন আমাদের রাজত্ব। আমাদের বিরক্ত কোরো না। ভালোয় ভালোয় ফিরে যাও।
গৌড়-পাণ্ডুয়ার মুখে যে কয়েকটা আদিবাসীদের মাটির ঘর ছিল, সূর্য ডোবার আগেই সেসব ঘরের দরজা-জানলা বন্ধ হয়ে যেত। কেউ আর বেরোত না। একটা অজানা ভয়। সে ভয় কিসের তা কেউ বলতে পারত না। শুধু মনে হতো মৃত নিষ্ঠুর সুলতানদের অতৃপ্ত আত্মারা ঘুরে বেড়াচ্ছে। জীবিত অবস্থায় যেমন তেমনি মৃত্যুর পরও কখন যে কার ওপর তাদের কোপ ও দৃষ্টি পড়বে কেউ তা বলতে পারত না।
জেকব অ্যান্টনী অবশ্য এসব বিশ্বাস করত না। সে বলত ওসব মূর্খ ভীতু মানুষদের মনের ভুল–অন্ধ কুসংস্কার।
আমিও তো তাই ভেবেছিলাম। কিন্তু শেষ পর্যন্ত যা ঘটল—
থাক সে কথা। এখন আমার সেই ডায়েরি থেকে লিখি।
.
৫ মার্চ ১৯৩৫
নতুন কিছু দেখার আনন্দে মন নাচছে। আজ রানাঘাট স্টেশন থেকে লালগোলা প্যাসেঞ্জারে উঠে লালগোলায় নামলাম। তারপর লালগোলা ঘাট। সেখান থেকে স্টীমারে পদ্মা পার হলাম। সে কী রোমাঞ্চ! এসব পথে কখনও আসিনি। জেকব একমনে কীসব নোট করছে। আমার সঙ্গে কম কথা বলছে। আমরা নামলাম গোদাগাড়ি ঘাটে। সেখান থেকে মিটার গেজের ট্রেনে মালদা ফোর্ট স্টেশন। আবার জলযাত্রা। এবার মহানন্দা নৌকোয় পার হয়ে এসে পৌঁছলাম মালদা টাউনে।
নামেই টাউন। টাউনের চাকচিক্য কিছু নেই। প্রাচীন ঐতিহাসিক স্মৃতির চাদর জড়িয়ে শহরটা যেন নতুন যুগের মানুষদের অবাক হয়ে দেখছে।
এখানে হোটেল-টোটেল বিশেষ নেই। অথচ হোটেল ছাড়া উঠব কোথায়? সঙ্গে দুজনেরই হালকা বেডিং। আমার কাঁধে একটা ব্যাগ। তাতে টর্চ তো আছেই তা ছাড়া আছে জামা কাপড় চটি-জুতো তেল সাবান গায়ের চাদর দড়ি ছুরি ইত্যাদি।