নিশ্চয় ভুল দেখছি মনে করে উঠে বসে দুচোখ রগড়ে নিলাম।
না, ভুল নয়। সত্যিই কোনো সুলতান দাঁড়িয়ে আছেন মাত্র দশ হাত দূরে দেওয়ালের কাছে। তাকিয়ে আছেন আমার দিকে আগুনঝরা চোখে। হঠাৎ দেওয়ালে আঙুল দিয়ে কিছু যেন লিখলেন তিনি। তারপরই ম্যাজিকের মতো অদৃশ্য হয়ে গেলেন।
আমি উঠতে গেলাম, কিন্তু পা দুটো ঠকঠক করে কাঁপতে লাগল। এত কাল পরে উনি হঠাৎ কেন এবং কি করে গৌড়ের ধ্বংসাবশেষ থেকে উঠে এসে আমার এই গরিবখানায় দেখা দিলেন বুঝতে পারলাম না। তবে উনি যে ক্রুদ্ধ হয়েছেন তা বুঝতে ভুল হয়নি।
সকালবেলা রতন গরম কফি নিয়ে এসে ডাকাডাকি করতে ঘুম ভেঙে গলে। ধড়মড় করে উঠে পড়লাম। তারপর কফি খেয়ে সুলতান যেখানে দাঁড়িয়ে ছিলেন সেখানে এগিয়ে গেলাম।
কী আশ্চর্য! দেওয়ালে ফারসী ভাষায় কাঁপা কাঁপা হাতে অস্পষ্ট কয়েক ছত্র লেখা।
ফারসী ভাষা কিছুটা শিখেছিলাম তাই পাঠোদ্ধার করে ফেললাম। লেখা হয়েছে–সাবধান! এই ডায়েরির কোনো অংশ কাউকে পড়ে শোনাবে না। এমনকি তোমার কাজের লোকটিকেও না। যদি শোনাও তাহলে তোমার স্বাভাবিক মৃত্যুর আগেই আমার হাতে মরতে হবে। নিচে সই নেই। তার বদলে আছে হাতের ছাপ। আঙুল তো নয় শুধু সরু সরু কয়েকটা হাড়।
.
জেকব অ্যান্টনী
সেই ক্রুদ্ধ, নিষ্ঠুর সুলতানের আত্মা আমাকে সাবধান করে দিয়েছিলেন আমি যেন ডায়েরির লেখা কাউকে পড়ে না শোনাই। কিন্তু ডায়েরির গোপন কথা নিয়ে লিখতে পারি কিনা সে বিষয়ে কিছু বলেননি। আর লিখলেও যদি তিনি আমার কোনো ক্ষতি করেন তো করুন। ভয় পাই না। কেন না আমি তো মৃত্যুর দরজায় পা বাড়িয়েই আছি। তাই ডায়েরির কথা শুরু করি।
সুলতান সৈফুদ্দীন হামজা শাহ বা ফিরোজ শাহ ছিলেন গৌড়ের সুলতান। সময় পঞ্চদশ শতাব্দীর শেষ। অর্থাৎ আজ থেকে প্রায় পাঁচশো বছর আগে। তিনি যে কী নিষ্ঠুর ছিলেন তা পরে বলব। এখন আগের ঘটনায় আসি।
জেকব অ্যান্টনী যার সঙ্গে আমি গৌড়-পাণ্ডুয়ার ধ্বংসাবশেষে গোপন অভিযান চালিয়েছিলাম, সে ছিল একজন খ্রিস্টান পর্যটক এবং প্রত্নতত্ত্ববিদ। যেখানে যত প্রাচীন ধ্বংসস্তূপ আছে সেখানে সে অভিযান চালাত। বৃটিশ গভর্নমেন্ট তাকে পুরনো জায়গা খোঁড়াখুঁড়ির অনুমতিও দিয়েছিল। তাতে দরকার হলে সে লোকজন নিয়েও অনুসন্ধান চালাতে পারত।
আমি থাকতাম দেশের বাড়িতে। মা-বাবা মারা গেছেন আমার ছোটোবেলায়। আমার কেউ কোথাও ছিল না। ফলে বেশ বেপরোয়া আর দুঃসাহসী হয়ে উঠেছিলাম। বাবার কিছু টাকা ছিল। ছিল মাথা গোঁজবার জায়গা। আর ছিল কিছু ধানজমি। কাজেই একা মানুষের বেশ কেটে যেত।
এছাড়া করতাম গাইডের কাজ। আমাদের এলাকায় অনেক পুরনো মন্দির আছে। আছে বর্ধমান মহারাজাদের রাজবাড়ি। সারা বছর টুরিস্টরা আসত। তাদের আমি খুব আগ্রহভরে সেইসব মন্দির আর রাজপরিবারের ইতিহাস শোনাতাম। অবশ্য বাবার কাছ থেকেই সব শুনেছিলাম। বাবা এক সময়ে রাজ এস্টেটে কাজ করতেন। টুরিস্টরা খুশি হয়ে আমাকে কিছু কিছু দিত। সেটাও আমার লাভ।
আমার নেশা ছিল বনে-জঙ্গলে যেখানে যত ভাঙা মন্দির-মসজিদ আছে সেখানে ঘুরে বেড়ানো। কত কী যে লক্ষ্য করতাম তা লিখে বোঝাতে পারব না।
সেদিনও বাড়ি থেকে একটু দূরে নদীর ধারে ঘুরছিলাম। এখানে লম্বা সার দেওয়া বহু প্রাচীন ইটের গাঁথনি আছে। অনেক জায়গাতেই ইট নেই। হয়তো ভেঙে পড়ে গেছে। কিংবা চুরি গেছে। এখানে বড়ো একটা কেউ আসে না। তাই আমি বেশ একা একা ঘুরে বেড়াই। এই ইটের সারগুলো দেখে আমার কত কী মনে হয় যা কাউকে বলা যায় না। লোকে পাগল বলবে।
হঠাৎ জুতোর মসমস শব্দ শুনে চমকে ফিরে দেখি প্যান্ট-কোট পরা, মাথায় হ্যাট একজন লোক মুখে চুরুট গুঁজে এই দিকে আসছে। তার কাঁধে চামড়ার মস্ত ব্যাগ।
আমাকে দেখে চুরুট সরিয়ে হেসে বলল, What are you doing here young man?
লোকটার গায়ের রঙ কালো। ঠোঁটের ওপর পুরু গোঁফ। বেশ সুস্থ-সবল বেঁটে-খাটো চেহারা। দুচোখে ধূর্ত চাউনি। দেখলেই মনে হয় শুধু কর্মঠই নয়, সাহসীও।
উত্তরে আমি বললাম, আপনি কোথা থেকে আসছেন? আপনাকে তো কখনো দেখিনি।
লোকটা ঝপ করে ঘাসের ওপর বসে ব্যাগ থেকে জলের বোতল বের করে ঢকঢক করে খানিকটা খেয়ে নিয়ে বলল, আমার নাম জেকব অ্যান্টনী। আপাতত এসেছি কর্ণসুবর্ণ থেকে। কর্ণসুবর্ণ কোথায় জান তো?
বললাম, জানি বৈকি। মুর্শিদাবাদ জেলায়। ঐতিহাসিক জায়গা। এক সময়ে বাংলার রাজধানী ছিল।
ভেরি গুড। তুমি তাহলে হিস্টোরিকাল জায়গাটায়গার খবর রাখ?
হ্যাঁ। ঐতিহাসিক জায়গাগুলো দেখতে আমার খুব ইচ্ছে করে।
ভেরি গুড, ভেরি গুড।
আপনি আমাদের দেশে কী করতে এসেছেন?
জেকব হেসে বলল, বাঃ! আসব না? তোমাদের এই কালনা তো বহু পুরনো জায়গা। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির আমলে কালনার বানান কি লিখত জান?
আমি মাথা নাড়লাম।
Culna-কুলনা।
আমি অবাক হয়ে গেলাম।
জেকব বলতে লাগল, এখানে মুসলমান আমলের বেশ কয়েকটা ভাঙা মসজিদ আছে। বর্ধমান রাজাদেরও অনেক কীর্তি আছে।
আমি বলে উঠলাম, বর্ধমানের রাজাদের দুটো সমাজবাড়িও আছে। একটা পুরনো সমাজবাড়ি, আর একটা নতুন সমাজবাড়ি।
What? সমাজবাড়ি?
হ্যাঁ। রাজপরিবারের প্রয়াত সদস্যদের অস্থিভস্ম এই দুই সমাজে রাখা আছে।