ঝড়টা তখন থেমেছে। কিন্তু মাঝে মাঝেই ঝাঁপটা বাতাস বইছে। আকাশ অন্ধকার।
আপনি শুধু ওর কোয়ার্টারটা দেখিয়ে দিন। একবার সেখানে যাব। উনি আমাদের আসতে বলেছিলেন।
যাওয়াই ভালো। তবু যদি যেতে চাও, ঐ ইউক্যালিপটাস গাছটার পিছনে গেলেই পাবে।
ওরা যখন যাচ্ছিল মেমসাহেব ব্যাকুল হয়ে বললেন, তোমরা সত্যিই যাচ্ছ? প্লিজ যেও না।
আমাদের যেতেই হবে। হ্যারিকাকুকে আমরা কথা দিয়েছিলাম আসব বলে।
তবে এই ক্রুসটা সঙ্গে রাখো।
.
পুরনো একটা ঘর। ঘরের চারদিকে ভাঙা পাঁচিল। দুপাশে ঝোপঝাপ। একটা ছোটো কাঠের গেট।
ওরা গেট ঠেলে ভেতরে ঢুকল। এক ফালি রক। রকের সামনে দরজা। এই সময়ে প্রচণ্ড ঝড় উঠল। ঝড়ের ধাক্কায় দরজা খুলে গেল।
অন্ধকার ঘর। দেশলাই জ্বালতে জ্বালতে ওরা এগোল। মেঝেতে অনেকগুলো ছেঁড়া পাতা উড়ছে। বাপ্পা কয়েকটা পাতা তুলে নিল।
কিরে ওগুলো? রঞ্জু ঝুঁকে পড়ে জিজ্ঞেস করল।
মনে হচ্ছে জোসেফ ইভেন্সের সেই ডায়েরি।
ইস্! এইভাবে ছিঁড়ল কে?
বাপ্পা কোনো উত্তর দিল না।
দেওয়ালে সাদা কাগজে কী যেন লেখা। বাপ্পা আবার দেশলাই জ্বালালো। লেখাটা পড়া গেল–Be one with Him!
সেই অন্ধকারে দাঁড়িয়ে হঠাৎই রঞ্জু বলে উঠল, আমার শরীর কিরকম করছে। আমি বাইরে যাব।
বাপ্পা বলল, আমারও অস্বস্তি হচ্ছে।
তারপর শান্ত গলায় বলল, এখানে এসেছি যখন আয়, পাঁচ মিনিট আমরা হ্যারিকাকুর জন্যে প্রার্থনা করি।
দুজনে সেই লেখাটার নিচে হাঁটু পেতে বসল।
সবে মিনিট দুই হয়েছে, হঠাৎ প্রচণ্ড একটা ঝড় আর্তনাদ করে ঘরে ঢুকে পড়ল। আর তখনই তারা দেখল ভেতরের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে সর্বাঙ্গে সাদা চাদর-জড়ানো একটা মূর্তি। তার সারা মাথায় জট-পাকানো সাদা চুল, মুখে সাদা খোঁচা খোঁচা দাড়ি। দুচোখে মরা মাছের দৃষ্টি। তার সামনের দাঁতগুলো ঠোঁটের নিচ থেকে বেরিয়ে এসে ঝক্ঝক্ করছে।
হ্যারিকাকু!
হা, হ্যারিকাকু হাসছেন!
হ্যা-রি-কা-কু! বলে রঞ্জু চিৎকার করে উঠল।
হ্যা-রি-কা-কু, আমরা এসেছি।
দেখা গেল হ্যারিকাকু শীর্ণ ডান হাতখানা বাড়িয়ে দিয়েছেন–তুষারশুভ্র হাত। সে হাতে এতটুকু মাংস নেই, যেন হ্যান্ডশেক করতে চাইছেন।
[শারদীয়া ১৪০১]
সুলতানের কবর
দেওয়ালে হাতের ছাপ
কোনো মূল্যবান জিনিস বাড়ি থেকে হঠাৎ কর্পূরের মতো উবে গেলে মানুষ কতদিন তার খোঁজ করতে পারে? বড়ো জোর এক মাস, দুমাস। তারপর হাল ছেড়ে দিয়ে বসে থাকে। মনকে বোঝায় নিশ্চয় ওটা চুরি গেছে। চুরি হয়ে গেলে আর ফিরে পাবার উপায় নেই।
আমার যে জিনিসটা ট্রাঙ্কের ভেতর থেকে হঠাৎ অদৃশ্য হয়ে গেল, তা কেমন করে গেল তা কিছুতেই বুঝে উঠতে পারিনি। জিনিসটা আমার একটা ডায়েরি। বাড়িতে আমি একা। আমার কোনো দিনই এমন বন্ধু-বান্ধব ছিল না যে কাউকে পড়তে দেব। পড়তে দেওয়া দূরের কথা, কাউকে পড়েও শোনাইনি। অথচ ডায়েরিটা উধাও হয়ে গেল।
ডায়েরিটা অন্যের কাছে এমন কিছু মূল্যবান নয়। কিন্তু আমার কাছে ওর মূল্য অপরিসীম। আবার এটাও ঠিক ঐ ডায়েরিতে এমন কিছু গোপন তথ্য ছিল যা পড়লে যে কেউ লুব্ধ হতে পারে। তারপর হয়তো আমাদেরই মতো ছোটোখাটো একটা অভিযান চালাতে গিয়ে
যাক সে কথা।
তা সেই ডায়েরিটার জন্যে সারা বাড়ি তন্ন তন্ন করে খুঁজেছি, সম্ভব-অসম্ভব কোনো জায়গাই বাদ দিইনি। আর এই কাজ করেছি কয়েক বছর ধরে। তারপর একদিন হতাশ হয়ে হাত গুটিয়ে নিয়েছিলাম।
এরপর সেদিন আমার এই তিরাশি বছর বয়েসে হঠাৎই সেই ডায়েরিটা খুঁজে পেলাম।
কোথায় পেলাম জান? আমার বইয়ের আলমারির ওপর। কেউ যেন এইমাত্র ওটা ওখানে রেখে দিয়ে গেছে। অথচ ঐ জায়গায় আমি কত দিন ধরে কত বার খুঁজেছি!
বুঝতে পারি না আমার ট্রাঙ্কের নিচে যেখানে সেই ১৯৩৫ সালে ওটা রেখে দিয়েছিলাম, তারপর যে কোনো কারণেই হোক ঐ ডায়েরিটা ছুঁতে আর ভরসা পাইনি, সেই ডায়েরিটা ওখান থেকে কে কিভাবে বের করে নিল? আর এতগুলো বছর পর কেই বা সেটা আমার নাকের ডগায় রেখে দিয়ে গেল? রেখে দিয়ে গেল এমন একটা সময়ে যখন দুরারোগ্য রোগে আমি একরকম শয্যাশায়ী। যখন আমি মৃত্যুর জন্যে দিন গুনছি।
ডায়েরিটা কেমন করে উধাও হয়ে গিয়েছিল, সে রহস্য নিয়ে মাথা ঘামাতে চাই না। ওটা যে পেয়েছি এটাই আমার মস্ত বড় লাভ। মৃত্যুর আগে অন্তত আর একবার ডায়েরিটা পড়ে নিতে পারব।
রাতে শোবার আগে রতন আমায় যেমন নিয়মিত ওষুধ আর ঘুমের বড়ি খাইয়ে দেয়, তেমনি খাইয়ে পাশের ঘরে শুতে চলে গেল।
ভেবেছিলাম বহুকাল পরে ডায়েরি ফিরে পাওয়ার আনন্দে নিশ্চিন্তে ঘুমোব। কিন্তু তা হলো না। গভীর রাতে একটা ঘটনা ঘটল।
আমার বিছানার কাছেই একটা ছোটো টেবিলে কিছু দরকারি ওষুধ-পত্তর, টর্চ আর একটা টাইমপিস থাকে। মাঝে মাঝে যখন ঘুম ভেঙে যায় তখন টাইমপিসটা দেখি কটা বাজল। প্রহর গুনি কখন ভোর হবে।
আজ হঠাৎ একটা খসখস শব্দে ঘুম ভেঙে গেল। রতন কি এ ঘরে ঢুকেছে? মশারির মধ্যে থেকে হাত বাড়িয়ে টর্চটা নেবার আগেই দেখলাম ঘরের মধ্যে একটা দীর্ঘ ছায়ামূর্তি। ক্রমে সেটা মানুষের মতো আকৃতি নিল। পরিষ্কার দেখলাম তার গায়ে রাজপোশাক ঝলমল করছে। কোমরে মস্ত বড়ো তরোয়াল, পায়ে ভেলভেটের নাগরা। মনে হলো বিগত যুগের কোনো সুলতান।