জোসেফ ইভেন্সের সেই কথাগুলো ভুলে গেলি? পরোপকারবৃত্তি আর প্রচণ্ড সাহস এই হলো বাঁচার অস্ত্র। আজ পর্যন্ত ভূতের হাতে প্রাণ হারিয়েছে ভীতুর দল। যারা সর্বশক্তি দিয়ে প্রেতাত্মার দিকে ছুটে যেতে পারে তারা মরে না। বরঞ্চ দুষ্ট আত্মাই পালায়। মানুষ যেমন ভূতকে ভয় পায়, ভূতও তেমনি ভয় পায় মানুষকে।
ট্রেন চলেছে। দুপাশে রুক্ষ মাটি। বাংলা দেশের মতো শস্যশ্যামল সমতল জমি আর নেই। উঁচু-নিচু মাঠ যেন ঢেউ খেলিয়ে ছড়িয়ে আছে। হুহু করে বাতাস আসছে খোলা জানলা দিয়ে।
রঞ্জুর একটু ঝিমুনি এসেছিল। একসময়ে সামলে নিল। সলজ্জভাবে তাকাল বাপ্পার দিকে। দেখল বাপ্পা জানলা দিয়ে মুখ বাড়িয়ে যেন অস্বস্তির সঙ্গে কী দেখেছে।
কী দেখছিস অমন করে?
বাপ্পা উত্তর দিল না। শুধু আঙুল দিয়ে আকাশ দেখিয়ে দিল।
রঞ্জু দেখল আকাশের দক্ষিণ-পূর্ব কোণ থেকে কালো মেঘ একটা দৈত্যের মতো হুহু করে এগিয়ে আসছে।
বাপ্পা চুপ করে রইল।
জগদীশপুরে ওরা যখন নামল তখন বাতাসের গোঙানি শুরু হয়ে গিয়েছে।
ছোট স্টেশন। প্যাসেঞ্জার যে কজন নামল আঙুলে তা গোনা যায়। একটা টাঙ্গাও পাওয়া গেল। তাকে ফাদার স্যামুয়েলের কোয়ার্টার বলতে সে কিছুই বুঝল না। কিন্তু যখন বলা হলো পুরনো গির্জা–তখন সে বুঝল, বটে কিন্তু ও এতই অবাক হয়ে গেল যে ভাড়া বলতে ভুলে গেল।
যাই হোক, ভাড়া ঠিক করে ওরা দুজনে টাঙ্গায় উঠে পড়ল। ততক্ষণে ঝড়ের দাপট তীব্র হয়ে উঠেছে। তারই মধ্যে দিয়ে টাঙ্গার বুড়ো ঘোড়াটা প্রাণপণে ছুটছে…পিঠের ওপর চাবুক পড়ছে সপাং সপাং
জায়গাটা একেই জনবসতিবিরল। টাঙ্গা যতই এগোচ্ছে ততই যেন নির্জন এক জগতে তারা প্রবেশ করছে। খোয়া বের করা, ধুলো-ভরা সরু রাস্তা। দুপাশে শুধু আতা-পেয়ারার গাছ, সার সার বাবলা গাছের পাতলা ছায়া আর ঝোপঝাপ।
ও হে গাড়োয়ান, স্যামুয়েল সাহেবের কোঠী আর কেতনা দূর?
গাড়োয়ান কোনো উত্তর দিল না। গাড়ি ছুটছেই। এদিকে ঝড়টা কখনো কমছে কখনো জোরে হচ্ছে। যখন জোর ঝাঁপটা মারে–এরা মুখে চোখে রুমাল চেপে ধরে। ধুলো আর ধুলো।
শেষ পর্যন্ত টাঙ্গাটা যেখানে এসে থামল সেখানে শুধু জঙ্গল আর ঝোপঝাড় ছাড়া আর কিছুই চোখে পড়ল না। রাস্তাটাও যেন হঠাৎই সেখানে শেষ হয়ে গেছে।
গির্জা কঁহা?
গাড়োয়ান কথা বলল না। হাত তুলে দক্ষিণ দিকটা দেখিয়ে দিল।
হ্যাঁ, ঐ যে গির্জার মতো কী একটা দেখা যাচ্ছে।
টাঙ্গাওয়ালার ভাড়া মিটিয়ে দিয়ে দুজনে নামল।
রঞ্জু বলল, হ্যারিকাকু তো আচ্ছা জায়গায় সাধনা করতে এসেছেন!
ওরা দুজনে চার্চটার কাছে এগিয়ে গেল। চার্চের অবস্থা দেখে ওরা অবাক। জীর্ণ বিবর্ণ দেওয়াল। জানলাগুলো ভাঙা। কেউ যে এখানে প্রেয়ার করতে আসে তার কোনো লক্ষণই নেই। দরজায় একটা তালা ঝুলছে।
রঞ্জু বলল, এর মানে কী? চার্চেরই যখন এই অবস্থা তখন পাদ্রী এখানে কী করেন? তার থাকার দরকারটাই বা কী?
বাপ্পা বলল, যাই হোক, তিনি নিশ্চয়ই কাছেই কোথাও থাকেন। নইলে হ্যারিকাকু ঠিকানা দিলেন কি করে? আর হ্যারিকাকু তো ওঁর কাছেই থাকেন।
ওরা এদিক ওদিক দেখতে লাগল। কিন্তু কোনো কোয়ার্টার চোখে পড়ল না।
এ তো আচ্ছা রহস্য। রঞ্জু বেজার হয়ে উঠল।
বাপ্পা কী বলতে যাচ্ছিল, দেখল এক বুড়ি যেন কুঁজো হয়ে ঠুকঠুক করতে করতে চার্চের দিকেই আসছে। তিনি এদের কাছে এলেন, কিন্তু যেন এদের দেখতেই পেলেন না। তিনি গুটি গুটি চার্চের দরজার কাছে গিয়ে ব্যাগ থেকে চাবি বের করে তালা খুলতে লাগলেন।
বাপ্পা কাছে গিয়ে বলল, ম্যাডাম, ফাদার স্যামুয়েলের কোয়ার্টারটা কোথায় বলতে পারেন?
মেমসাহেব তাঁর ঘোলা ঘোলা চোখ দুটো তুলে জিজ্ঞাসা করলেন, কোথা থেকে আসছ?
কলকাতা থেকে।
তোমরা কি ফাদারের সঙ্গে দেখা করতে এসেছ?
হ্যাঁ ওর সঙ্গেও বটে। আবার ওঁর কাছে থাকেন মিস্টার হ্যারোল্ড ইভেন্স, তাঁর সঙ্গেও বটে।
বাপ্পা লক্ষ করল হ্যারোল্ড ইভেন্সের নাম শুনে মেম যেন চমকে উঠলেন।
একটু সামলে নিয়ে বললেন, কিন্তু ফাদার তো এখানে নেই।
নেই! ওরা দুজনে একসঙ্গে যেন হোঁচট খেল।
হ্যাঁ, উনি হঠাৎ কোথায় চলে গেলেন।
কোথায় গেলেন বলে যাননি?
না। সে এক অদ্ভুত ব্যাপার। লাস্ট সানডে। হঠাৎ রাত দুটোর সময়ে ফাদার হাঁপাতে হাঁপাতে আমার কাছে গিয়ে চার্চের চাবিটা দিয়ে বললেন, আমি চলে যাচ্ছি। আমায় কিছু প্রশ্ন করো না। বলেই তিনি সেই অন্ধকার রাত্রে বেরিয়ে গেলেন। তার চোখে মুখে অস্বাভাবিক ভয়ের ছাপ দেখেছিলাম।
ভয়ের ছাপ! বাপ্পা উত্তেজিতভাবে জিজ্ঞেস করল।
হ্যাঁ, অমন ভয় পেতে এর আগে কখনো দেখিনি।
তারপর আপনি আর ওঁর কোয়ার্টারে গিয়েছিলেন?
আর কিছু প্রশ্ন করো না। উত্তর দেব না। বলে ব্যাগ থেকে দুটো মোমবাতি নিয়ে দরজা খুলে চার্চে ঢুকতে গেলেন। বাধা দিয়ে বাপ্পা বলল, শুধু আর একটা প্রশ্ন। মিস্টার ইভেন্স কোথায়? উনি কি একাই আছেন? ভালো আছেন তো?
মেমসাহেবের হাত থেকে একটা মোমবাতি পড়ে গেল। তিনি কেমন একরকমভাবে বাপ্পার দিকে তাকিয়ে রইলেন। তারপর কঁপা কাঁপা গলায় বললেন, তিনি লাস্ট সানডে রাত্রে মারা গেছেন।
মারা গেছেন?
হ্যাঁ, প্লিজ আমায় কিছু প্রশ্ন করো না। আমি মোম দুটো জ্বালিয়ে দিয়েই চলে যাব। বলে আকাশের দিকে তাকালেন।