হ্যারিকাকু এদিন বেশি কথা বলতে পারেননি। কোনোরকমে দরজা খুলে দিয়েই বিছানায় শুয়ে পড়েছেন।
কেমন আছেন হ্যারিকাকু?
ক্যাম্পখাটটার দপাশে দুজনে বসে জিজ্ঞেস করল।
ঠিক জানি না।
এ এমন একটা উত্তর যার ওপর আর প্রশ্ন করা যায় না।
কিন্তু চারিদিকে এত সাদা কেন?
হ্যারিকাকুর সেই ভরাট গলা আর নেই। ফ্যাকাশে গলায় বললেন, সাদাই তো সব। সাদাই পবিত্রতা।
বলে শীর্ণ হাতটা বাড়িয়ে দিলেন রঞ্জু আর বাপ্পার দিকে।
.
০৮.
লোহিত সাগরের আতঙ্ক
কয়েক মাস পর বাপ্পা হ্যারিকাকুর সেই চিঠিখানা পেল।
চিঠিখানা পেয়ে বাপ্পা আশ্চর্য হলো, তাহলে এই শেষ বয়সে হ্যারিকাকু সত্যিই কলকাতা ছেড়ে চলে গেলেন ছোটোনাগপুরের একটা অখ্যাত জায়গায় নির্বিঘ্নে প্রেততত্ত্ব সাধনা করতে। কিন্তু ভীত হয়ে পড়ছেন কেন? সেই অশরীরী দানবটা কি সেখানেও হানা দিচ্ছে?
যাই হোক, তাকে জগদীশপুরে যেতেই হবে। তাদের দুজনকে হ্যারিকাকু আকুলভাবে ডেকেছেন।
পরের দিন বাপ্পা কলকাতায় চলে এল। দেখল রঞ্জুও ঐরকম চিঠি পেয়েছে। একই বক্তব্য–একই ভাষা।
কবে যাবি? রঞ্জু জিজ্ঞেস করল।
আজই।
কিন্তু
কি ভাবছিস?
ভাবছি মা-বাবাকে কী বলব! সত্যি কথা বললে যেতে দেবে না। ঠিক আছে–এমনি বেড়াতে যাচ্ছি বললে আপত্তি করবে না। বিশেষ যখন তুই সঙ্গে আছিস। বলে রঞ্জু একটু হাসল।
রঞ্জুর বাবা কিছু বলেননি। রঞ্জুর মা গজগজ করলেন, শুধু শুধু এখানে-ওখানে ঘুরে বেড়ানো–এ আবার কী? তাড়াতাড়ি ফিরো।
যাবার সময়ে বাপ্পা বললে, হ্যারিকাকুর ঠিকানাটা একটা স্লিপে লিখে টেবিলে রেখে যাস। বলা যায় না যদি কোনো কারণে আটকে যাই।
সেদিনই রাত্রে মোগলসরাই প্যাসেঞ্জারে ওরা চাপল। সারারাত ট্রেনে। যতক্ষণ না ঘুম এসেছিল ততক্ষণ ওরা হ্যারিকাকুকে নিয়ে আলোচনা করল।
বাপ্পা বলল, একটা কথাই ভাবছি–হ্যারিকাকু কেন লিখলেন ভীত হয়ে পড়ছি!
নিশ্চয় ওখানেও সেরকম কিছু ঘটেছে।
কিন্তু ওখানে তো তিনি একা নন। পাদ্রী সাহেবও আছেন। তিনিই তো তাকে অনেক দিন ধরে ডাকছেন। তিনি আবার হ্যারিকাকুর বন্ধু। তাহলে?
রঞ্জু বলল, কলকাতায় যেদিন সন্ধেবেলা ঝড় ওঠার সঙ্গে সঙ্গে ঐরকম মারাত্মক ঘটনাটা ঘটল সেদিন তো আমরাও ছিলাম।
বাপ্পা চিন্তিতভাবে বলল, তা বটে। একটু থেমে বলল, আর একটা জিনিস লক্ষ করেছিলি? হ্যারিকাকুর কিরকম তাড়াতাড়ি পরিবর্তন হচ্ছিল। প্রথম দিনের সেই হ্যারিকাকু যিনি হ্যাট মাথায়, ছড়ি হাতে ওয়েলেসলির দিকে হাঁটছিলেন, তিনি যেন শেষের দিকে আর বেরোতেই পারছিলেন না। অথচ ক মাসেরই বা তফাত! শুধু তাই নয়, যিনি প্রথম দিকে কাঠখোট্টা মানুষ ছিলেন, ট্যারা ট্যারা কথা বলতেন, তিনিই ক্রমশ যেন কেমন ভীতু হয়ে পড়লেন। কথা বলতে বলতে হাত, ঠোঁট কাঁপত।
রঞ্জু সায় দিয়ে মাথা দোলাল।
তারপর হঠাৎ তার সাদার ওপর প্রীতি উথলে উঠল। লাল গোলাপের জায়গায় সাদা গোলাপ এল। জানলার পর্দা, বিছানার চাদর, টেবিলক্লথ সব সাদা। তিনি যেন হঠাৎ কেমন দার্শনিক হয়ে উঠলেন!
আর ওঁর সেই বড়ো বড়ো সাদা দাঁতের হাসি! বাবা গো!
অথচ উনি কম হাসতেন। ওঁর ঐরকম বড়ো বড়ো সাদা দাঁত আগে কখনো চোখে পড়েনি।
আর শেষ যেদিন দেখা করে এলাম সেদিন তো উনি একেবারে শয্যাশায়ী। ভালো করে কথাই বলতে পারলেন না।
এখানে একটা কথা ভাববার আছে রঞ্জু। যে মানুষকে মুমূর্ষ অবস্থায় দেখে এসেছি সে মানুষ কি এত গুছিয়ে চিঠি লিখতে পারে?
রঞ্জু বলল, চিঠি বোধহয় উনি লেখেননি। পাদ্রী সাহেবকে দিয়ে লিখিয়েছেন। তিনিও তো বৃদ্ধ। তাই কাঁপা কাঁপা লেখা।
বাপ্পা একটু ভেবে বলল, তা হতে পারে। কিন্তু চিঠির প্রথমটা পড়।
রঞ্জু পকেট থেকে চিঠিটা বের করল।
বাপ্পা আঙুল দিয়ে চিঠির প্রথম দিকটা দেখিয়ে দিয়ে বলল, এইরকম সহজ স্বাভাবিকভাবে কোনো মুমূর্য মানুষ dictate করতে পারে? আমাদের যাওয়া যখন এতই জরুরি তখন তো টেলিগ্রাম করলেই চলত। তাই না?
এটা কি তবে আগে লিখে রাখা?
তারিখটা দ্যাখ তো? বলেই বাপ্পা চিঠির ওপরে ঝুঁকে পড়ল।
আশ্চর্য! কোনো তারিখ নেই।
এর মানে কী?
অনেক ভেবে রঞ্জু বলল, হয়তো ভুলে গেছেন।
কিন্তু যুক্তিটা কারো মনঃপূত হলো না।
সকালে ওরা পৌঁছল মধুপুর। তারপর চড়ে বসল গিরিডির ট্রেনে।
স্টেশনে দুটো কেক আর দু ভড় চা খেয়ে ওরা জানলার ধার নিয়ে আরাম করে বসল। ট্রেন ছাড়ল। ওরা গল্প করছিল। কিন্তু গল্প করাতেও ক্লান্তি। প্রথমত, সারারাত ভালো ঘুম হয়নি, দ্বিতীয়ত, মনে চাপা দুর্ভাবনা কে জানে হ্যারিকাকুকে কী অবস্থায় দেখবে? ত. ছাড়া ভয়ও আছে। এ তো শুধু অসুস্থ একজনকে দেখতে যাওয়া নয়। এমন একজনকে দেখতে যাওয়া যে এক মহাশক্তিশালী অশরীরী আত্মার শিকার।
আমি কিন্তু প্রস্তুত হয়েই যাচ্ছি। বাপ্পা সকৌতূহলে তাকাল।
রঞ্জু হেসে পকেট থেকে একটা বালা বের করে দেখাল।
কী ওটা? লোহার বালা মনে হচ্ছে!
রঞ্জু বলল, হ্যাঁ, যদি আবার সত্যিই এসবের পাল্লায় পড়ি তাহলে
তাহলে লোহা তোকে বাঁচাবে?
রঞ্জু বলল, হারে, লোকে বলে সঙ্গে লোহা থাকলে ওরা ত্রিসীমানায় ঘেঁষে না।
তোর মাথা। তাহলে জাহাজে আর ওসব ঘটনা ঘটত না। জাহাজটায় তো লোহার অভাব ছিল না। ডেকের রেলিংগুলো কি কাঠের ছিল?
অকাট্য যুক্তি। রঞ্জু চুপ করে গেল।