তিনি বড়ো বড়ো থিওজফিস্টদের সঙ্গেও এই নিয়ে আলোচনা করলেন। বললেন, অতল সমুদ্র থেকে ঐ যে মূর্তিটা উঠে এল ওটা হাড়-মাংসের জীব নয়। চোখেরও ভুল নয়। তবে ওটা কি?
এ প্রশ্নের উত্তর পাওয়া যায়নি। যেমন উত্তর পাওয়া যায়নি কী করে তিনি নিজে রক্ষা পেলেন–কেনই বা সমুদ্র-দানবটা তাঁকে দেখে অমন ভয়ংকর চিৎকার করে লাফিয়ে পালিয়ে গিয়েছিল।
এই শেষ প্রশ্নের জবাবে সেদিন ইংলন্ড আর জার্মানির প্রেততত্ত্ববিদরা একবাক্যে বলেছিলেন, নিশ্চয় মিস্টার ইভেন্সের মধ্যে কোনো দৈবশক্তি আছে যা তিনি নিজেও জানেন না।
এর পর থেকে বেশ কিছুকাল ঐ জলপথে যখন জাহাজ যেত তখন ঐ জায়গাটায় এলে যাত্রীরা কেউ ডেকে থাকত না। তারা সবাই একসঙ্গে থাকত। হোলি বাইবেল পড়ত সমস্বরে। আর প্রত্যেকের হাতে থাকত ক্রুস।
এ সবই জোসেফ ইভেন্স তাঁর ডায়েরিতে লিখে গেছেন তার পুত্র-পৌত্র-প্রপৌত্রদের জন্যে। এ কথাও লিখেছেন, কোনো দৈবশক্তি সত্যিই আমার আছে কিনা জানি না। তবে আমার মনে হয় এ শক্তি আর কিছুই নয়–শুধু পরোপকারবৃত্তি আর সাহস। আমি যদি সেদিন সেই যাত্রীটিকে বাঁচাবার জন্যে মরিয়া হয়ে ঐ সমুদ্র-দানবের ওপর ঝাঁপিয়ে না পড়তাম তাহলে আরো একজনকে হারাতে হতো। আজ আমি কিছুতেই বোঝাতে পারব না সেদিন আমার ওপর কি এক অদ্ভুত শক্তি ভর করেছিল। নইলে আমি তো খুব সাধারণ একজন মানুষই।
শেষে লিখছেন, যাই হোক জীবনের শেষদিন পর্যন্ত আমি ঐ সমুদ্র-দানবের রহস্য ভেদ করার চেষ্টা চালিয়ে যাব। তার জন্যে যদি আমাকে সারা পৃথিবী ঘুরে বেড়াতে হয় তবু আমি পিছপা নই। আজ পর্যন্ত শুধু এইটুকু তথ্য পেয়েছি–একদল লোক নাকি মিশর থেকে একটা হাজার বছরের মমি চুরি করে জাহাজে করে ঐ পথে পালাচ্ছিল। জাহাজটা হঠাৎ ডুবে যায়, সেই সঙ্গে মমিটাও। তারপর থেকেই নাকি–এইটুকু তথ্য। এখনও আরো প্রমাণ দরকার।
ডায়েরি এখানেই শেষ। হ্যারিকাকু বললেন, কিন্তু তিনি বেশিদিন বাঁচেননি। একদিন সন্ধ্যায় পথ চলতে চলতে ঝড়ে গাছের ডাল চাপা পড়ে মারা যান।
হ্যারিকাকু একটু থামলেন। তারপর বললেন, এই ডায়েরি আসে আমার পিতামহের হাতে। তিনিও রহস্য ভেদ করতে করতে মধ্য বয়সেই আগুনে পুড়ে মারা যান।
তারপর আমার বাবা। তিনি এবার সেই মমির ইতিহাস সংগ্রহ করতে আরম্ভ করেন। কিন্তু বজ্রাঘাতে তার মৃত্যু হয়।
কথা বলতে বলতে হ্যারিকাকু ক্লান্ত হয়ে পড়ছিলেন। তবু বলতে লাগলেন, জোসেফ ইভেন্স থেকে পরপর তিন পুরুষের কেন এই অপমৃত্যু? তোমরা হয়তো বলবে ঘটনাচক্র। বলবে অপঘাতে কি মৃত্যু হতে পারে না?–ঠিক। তবু আমার মনে প্রশ্ন থেকেই যায়, এ কি সেই অলৌকিক অস্তিত্বটির প্রতিহিংসা–জোসেফ ইভেন্স অলৌকিক রহস্যের জাল ছিন্ন করে বিজ্ঞানের আলোয় সত্যকে উদঘাটন করে মানুষকে সাহস যোগাতে চেয়েছিলেন বলে?
আর যেহেতু তার বংশধরেরা সেই একই পথে এগোচ্ছিলেন তাই তাদের ওপর অকাল অপঘাত মৃত্যুদণ্ড।
যদি তাই হয় তাহলে বাপ্পা, রবিনসন, তোমরা জেনে রাখো এবার আমার পালা আসছে।
তাই কি আপনি ঘরের চারিদিকে ক্রুস চিহ্ন এঁকে রেখেছেন? বাপ্পা প্রশ্ন ছুঁড়ে দিল।
ধরে নাও তাই। যদি সেই করুণাময় পরম পিতার আশ্রয়ে থেকে আমি আমার সাধনা নির্বিঘ্নে চালিয়ে যেতে পারি, তারই চেষ্টা।
আপনি যখন এতদূর ভাবতে পেরেছেন তখন আর নাই এগোলেন!
না, তা সম্ভব নয়। যে রহস্য ভেদ করতে করতে আমার পূর্বপুরুষেরা জীবন দিয়েছেন সে কাজ আমিও করে যাব। এখন শয়নে-স্বপনে আমার শুধু ঐ একটি চিন্তা প্রেততত্ত্ব। ঐ দ্যাখো কত প্রেততত্ত্বের বই এই কমাসে যোগাড় করেছি। আর যদি অপঘাতে মৃত্যু হয় তাহলে হোক। আমি প্রস্তুত।
বলে তিনি ঠোঁট ছড়িয়ে হাসলেন। এমন ধবধবে সাদা বড়ো বড়ো একপাটি দাঁত বের করে হাসতে তাকে কখনো দেখা যায়নি। ওঁর দাঁতগুলো কি এত সাদা ছিল? ঐ দাঁত আর হাসি দেখে বাপ্পার গা ছমছম করে উঠল।
হ্যারিকাকু বললেন, এক একবার আমার কেমন মনে হয় যেন আমি আর সেই পুরনো আমি নেই। খুব একটা পরিবর্তন–অদ্ভুত পরিবর্তন নেমে আসছে আমার মধ্যে। জানি না পরিণতি কী! সেদিন এই পর্যন্ত।
.
০৭.
হ্যারিকাকুর ক্রমবিবর্তন
এর পর আগস্টের এক মেঘলা দুপুরে বাপ্পা আর রঞ্জু গিয়েছিল হ্যারিকাকুর বাড়ি। জাহাজের গল্প শোনা শেষ হয়ে গিয়েছে। নতুন গল্প শোনার আর তেমন আগ্রহ নেই। এখন শুধু দেখা করতে যাওয়া-খবর নিতে যাওয়া কেমন আছেন তাদের সেই রহস্যময় মানুষটি, যাঁর নাম হ্যারোল্ড ইভেন্স ওরফে হ্যারিকাকু।
দরজার সামনে সেই বড়ো সচিহ্ন। দরজার বিবর্ণ রঙটা যেন আরো ফিকে। হ্যারিকাকুই দরজা খুলে দিলেন। কিন্তু–এ কী চেহারা হয়েছে তাঁর। শরীরটা যেন একটা শুরু কাঠির মতো শীর্ণ হয়ে গেছে। মাথাভর্তি পাকা জট-পাকানো চুল–একমুখ পাকা দাড়ি। দু-চোখে ঘোলাটে দৃষ্টি। পিছনের দেওয়ালে শুধু সেই লেখাটা জ্বলজ্বল করছে–Be one with Him। তার সঙ্গে একাত্ম হও।
ঘরে ঢুকে ওরা অবাক হয়ে গেল। টেবিলে ফুলদানিতে আজ আর শুধুই সাদা গোলাপ নয়, টেবিলক্লথটিও সাদা। জানলা-দরজার বিবর্ণ নীল পর্দা আর নেই, তার বদলে সাদা পর্দা। বিছানার চাদর, বালিশের ওয়াড় সবই সাদা। আর যে হ্যারিকাকু বরাবর পরে এসেছেন ছিটের পা-জামা, তার পরনে সাদা পাজামা আর সাদা ফতুয়া!