কিছু ফল পেয়েছেন, মহিলাটি জিজ্ঞেস করলেন।
বোধহয় পেয়েছি। লামা আমায় বলেছেন, সেই প্রেতাত্মা এখনও আছে। হয়তো তার দেখাও পেতে পারো যদি ঠিকমতো একাত্ম হও। তবে সাবধান।
একাত্ম হও মানে? মহিলাটি জিজ্ঞেস করলেন।
ঠিক জানি না। বোধহয় ঐ একটি বিষয় নিয়ে তন্ময় হয়ে সাধনার কথা বলেছেন। কিন্তু কলকাতায় বসে সেরকম সাধনা করা বড়ো কঠিন হয়ে পড়েছে। এখানে বড্ড ডিস্টার্বেন্স।
তাহলে কলকাতার বাইরে কোথাও চলে যান, একান্তই যদি অপঘাতে মরার ইচ্ছে হয়ে থাকে।
আমি বললাম, দূরে কোথায় যাব? তেমন টাকা-পয়সা নেই, জায়গাও জানা নেই। তবে ছোটোনাগপুরে আমার এক বন্ধু আছে স্যামুয়েল। তাকে সব কথা জানিয়েছি। সে তো কেবলই বলে ওর কাছে চলে যেতে। জায়গাটা নাকি ঐ ধরনের সাধনার পক্ষে খুবই উপযুক্ত।
মহিলাটি আর কিছু না বলে চলে গেলেন। যাবার সময়ে আবার আমায় সাবধান করে দিয়ে গেলেন যেন আমি ওসব নিয়ে মাথা না ঘামাই।
উনি চলে যেতে না যেতেই হঠাৎ মেঘের গর্জন। সঙ্গে সঙ্গে ঝড়। তখন সবে সন্ধে। ঝড়ে নিচের সিঁড়ির দরজাটা ভয়ানক শব্দ করছিল। দরজাটা বন্ধ করার জন্যে নামতে যাব, দেখি লম্বা একটা মানুষ সর্বাঙ্গে চাদর জড়িয়ে উঠে আসছে এক-পা এক-পা করে। তার মুখ দেখা যাচ্ছে না।
তখনই আমি উঠে এসে টেবিল থেকে টর্চ নিয়ে নেমে গেলাম কিন্তু কাউকে দেখতে পেলাম না।
আর সেই মহিলা? রুদ্ধনিশ্বাসে জিজ্ঞেস করল বাপ্পা।
তাকেও দেখতে পেলাম না। ঐটুকু সময়ে ঝড়ের মধ্যেই রাস্তায় নেমে কোথায় যেন vanish হয়ে গেছেন। ঝড়ের মধ্যেই বেরনোর এমন কী তাড়া ছিল বুঝতে পারিনি।
কথা শেষ করে হ্যারিকাকু কোমরের পিছনে দু-হাত রেখে গম্ভীরভাবে পায়চারি করতে লাগলেন।
একটু পরে বাপ্পা বলল, তাহলে কাকু, এই পর্যন্ত বোঝা যাচ্ছে যে দুবার আপনি প্রায় একই জিনিস দেখেছিলেন। আর সেই দুবার দেখার আগে ভীষণ ঝড় উঠেছিল।
হ্যারিকাকু পায়চারি করছিলেন, দাঁড়িয়ে পড়লেন। একটু ভেবে বললেন, তা বটে।
আর এ ঝড় ঠিক সাধারণ ঝড় নয়।
সেটা ঠিক বলতে পারছি না।
তবে এটুকু বলা যায় ঝড়ের সঙ্গেই মূর্তিটার সম্বন্ধ। অর্থাৎ ঝড়ের মধ্যে দিয়েই তাঁর আবির্ভাব।
হ্যাঁ, তা অবশ্য বলতে পারো।
আর দুবারই আপনি এই বিশেষ ঝড়ের সময়ে ভয় পেয়েছিলেন।
হ্যারিকাকু একটু ভেবে বললেন, শেষবার ভয়টা খুব বেশি পেয়েছিলাম। কিন্তু প্রথমবার তেমন ভয় পাইনি। মনে করেছিলাম সাধারণ ঝড়।
রঞ্জু এতক্ষণ মন দিয়ে শুনছিল, এবার বলে উঠল, আরো একটা ব্যাপার নোটিশ করো বাপ্পা, যে দুবারই ঝড় উঠেছে বা কিছু দেখা গিয়েছে সেই দুবারই উনি কাউকে না কাউকে জাহাজের গল্পটা শুনিয়েছেন। সেবার সেই রহস্যময়ী মহিলাকে, এবার আমাদের।
বাপ্পা প্রায় লাফিয়ে ওঠে বলল, বাঃ! দারুণ পয়েন্ট ধরেছিস তো!
হ্যারিকাকু ভুরুতে ভাঁজ ফেলে রঞ্জুর দিকে তাকিয়ে রইলেন। যেন স্বগত বললেন, রাইট!
বাপ্পা বলল, কাকু, একটা রিকোয়েস্ট করব। ঐ জাহাজের ঘটনাটা কাউকে আর নাই বললেন।
হ্যারিকাকু সামান্য একটু হাসলেন। বললেন, আর কাউকে বলব কিনা জানি না, তবে ঐ বস্তুটা যে কী, কেন এভাবে এখানে হানা দেয়, আমি যতদিন বেঁচে থাকব ততদিন সে রহস্য ভেদ করবার চেষ্টা চালিয়ে যাব।
কিন্তু সেই যে লামা আপনাকে একাত্ম হও কথাটা বলেছিলেন তার মানে এতদিনে বুঝতে পেরেছেন?
না, এখনো তা ঠিক পারিনি। একাত্ম হও-এর মানে তো এই দাঁড়ায়, Be one with Him। কিন্তু এই Him কে?
বলতে বলতে হঠাৎ তিনি দুহাতে মাথা টিপে ধরে চেয়ারে বসে পড়লেন।
রঞ্জু বলল, কিন্তু সেই জাহাজের গল্পটা এখনো শেষ করেননি। মিস্টার জোসেফ ইভেন্স তারপর কী করলেন?
হ্যারিকাকু মাথা টিপে ধরে বললেন, হ্যাঁ, সেটা অবশ্যই বলতে হবে। তবে আজ আর কথা বলতে পারছি না। শরীরটা খুব দুর্বল লাগছে। তোমরা আর একদিন এসো।
.
০৬.
জোসেফ ইভেন্সের ডায়েরি
এবার ওদের আসতে দেরি হলো প্রায় চার মাস।
হ্যারিকাকুকে খুব ক্লান্ত আর বিষণ্ণ লাগছিল। মুখটা কিরকম ফ্যাকাশে হয়ে গেছে। গলার মোটা শিরাগুলো যেন চামড়া কুঁড়ে উঠে আসছিল।
হ্যারিকাকু তবু আন্তরিকতার সঙ্গে ওদের বসালেন। কফি তৈরি করে খাওয়ালেন। বললেন, আর কিছুদিন পরে এলে আমায় আর পেতে না।
কেন?
আমার সেই বন্ধু স্যামুয়েল বারবার আমায় ডাকছে। ভাবছি ওর কাছেই চলে যাব।
বাপ্পা চুপ করে শুনছিল আর ঘরটা দেখছিল। একটু যেন পরিবর্তন হয়েছে। ঘরটা বেশ গোছাল। বোধহয় চলে যাবেন বলেই ঘরটা গুছিয়েছেন। কিন্তু আশ্চর্য হলো টেবিলে সেই ফুলদানিতে লাল গোলাপের জায়গায় একটা বড়ো সাদা গোলাপ দেখে।
এবার সাদা গোলাপ দেখছি। আগে দেখতাম লাল গোলাপ।
হ্যারিকাকু বললেন, লাল গোলাপ আর পছন্দ হয় না। বড্ড যেন অহংকার। বড় আত্মপ্রচার!
বাপ্পা অবাক হলো। বাবা! হ্যারিকাকুর মুখে এসব আবার কী কথা! সত্যিই কি উনি শেষ পর্যন্ত সাধু-সন্ন্যাসী হয়ে যাবেন?
যাই হোক, কফি খেতে খেতে হ্যারিকাকু সেই জাহাজের ঘটনার শেষাংশটুকু বলে গেলেন।
..জোসেফ ইভেন্স এর পর লন্ডনে পৌঁছেই জাহাজের ঘটনা নিয়ে হৈচৈ বাধিয়ে দিলেন। সভা-সমিতি করলেন, কাগজের রিপোর্টারদের ডাকলেন। নিজের অভিজ্ঞতার কথা বললেন। সাক্ষ্য দিলেন জাহাজের কাপ্তেন স্বয়ং। তাছাড়া প্যাসেঞ্জারদের অনেকেই ছিল। জোসেফ গভর্নমেন্টের কাছে দাবি করলেন, ঐ সমুদ্র-দানবকে নিয়ে বৈজ্ঞানিক উপায়ে সন্ধান চালানো হোক।