এই যেমন একা বসে আছি, মনে হলো কেউ যেন আমার ঠিক পিছনে দাঁড়িয়ে আছে। এমনকি তার গরম নিশ্বাস পর্যন্ত টের পাচ্ছি। কিংবা বাথরুমে যাচ্ছি–মনে হলো কেউ যেন বাথরুম থেকে বেরিয়ে গেল। সিঁড়ি দিয়ে উঠছি অন্যমনস্কভাবে–আমার মনে হলো আমার ঠিক আগে আগে খালি পায়ে কেউ উঠছে। বড়ো বড়ো পা তুলোর মতো সাদা। এইরকম আর কি!
আপনার কি মনে হয় এই ঘরটাই haunted room, না শুধু আপনাকেই ভয় দেখানো?
আমাকে–আমাকেই ভয় দেখানো।
কী করে বুঝলে?
আমি বুঝতে পারি।
কিন্তু কেন?
এবার হ্যারিকাকু কোনো উত্তর দিলেন না। হঠাৎ ওর ঠোঁট, হাত, গা তিরতির করে কাঁপতে লাগল।
আপনার কি শরীর খারাপ লাগছে কাকু?
না, ঠিক আছি। তুমি একটু আগে জিজ্ঞেস করছিলে সেদিনের ঘটনার মতো ঘটনা আর কখনো ঘটেছিল কিনা। মনে পড়েছে। ঘটেছিল। তবে এরকম মারাত্মক নয়।
দয়া করে সে ব্যাপারটা বলুন না!
হ্যারিকাকু আবার কিছুক্ষণ অন্যদিকে তাকিয়ে চুপ করে রইলেন। তারপর বলতে লাগলেন, সে বেশ কিছুকাল আগের কথা। তখন আমি ছিলাম রডন স্ট্রিটের একটা বাড়িতে। আমার দুর-সম্পর্কের এক আত্মীয় জানায় যে, তার কাছে অনেক পুরনো অব্যবহার্য জিনিস আছে, সেগুলো অল্প দামে বেচে দিতে চায়। আমি প্রথমে রাজি হইনি। তারপর সে যখন জানাল যে জিনিসগুলো আমরাই পূর্বপুরুষদের তখন জিনিসগুলো অন্তত দেখার ইচ্ছে হলো।
গেলাম তাদের বাড়ি। মস্তবড়ো পুরনো একটা কাঠের সিন্দুকে অনেক কিছুই ছিল। যেমন, কিছু বাসনকোসন, ফুলদানি, টেবিল-ল্যাম্প, একটা সেলাই মেশিন, এইরকম সব।
আমি কিছু নিলাম, অনেক কিছুই নিলাম না। যেটা সবচেয়ে পছন্দ হলো সেটা ঐ জাহাজের ছবিটা। আর একটা অমূল্য জিনিস পেলাম, সেটা একটা ডায়েরি। ডায়েরিটা আমার ঠাকুরদাদার বাবার। তার নিজের হাতের লেখা। সেদিন তোমাদের যে জাহাজের ঘটনাটা বলেছিলাম সেটা ঐ ডায়েরি থেকে পাওয়া। সেই ডায়েরিতেই লেখা আছে ছবিটার কথা। এটা সেই জাহাজের ছবি যে জাহাজে একদিন আমার ঠাকুরদার বাবা সমুদ্রযাত্রা করেছিলেন।
তিনিই বোধহয় জোসেফ ইভেন্স? বাপ্পা বলে উঠল।
হ্যাঁ, তাই। যাই হোক, সেই জাহাজের ছবি জেনে আমি ছবিটা ভালো করে বাঁধিয়ে রাখলাম।
একটু থামলেন হ্যারিকাকু। তারপর বললেন, প্রথম দিনই তুমি খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে ছবিটার কথা জানতে চেয়েছিলে। ছেলেমানুষের এত আগ্রহ দেখে অবাক হয়েছিলাম, বিরক্তও হয়েছিলাম। তাই এড়িয়ে গিয়েছিলাম।
চুরুটটা নিভে গিয়েছিল। হ্যারিকাকু কয়েকটা দেশলাইয়ের কাঠি ধ্বংস করে চুরুটটা আবার ধরালেন।
কিন্তু আঙ্কেল, আপনি যে বলেছিলেন কী দেখেছিলেন!–রঞ্জু অধৈর্য হয়ে উঠল।
Dont worry my boy! ব্যস্ত হয়ো না। বলছি। গোড়া থেকে না বললে ঠিক বোঝা যায় না।
যাই হোক, ছবিটা এনে আমার বাইরের ঘরে টাঙিয়ে রেখেছিলাম। একদিন অচেনা এক মহিলা হঠাৎ এলেন কী একটা কাজে। ছবিটা দেখে মুগ্ধ হয়ে গেলেন। বেশ ভালো টাকা দিয়ে ছবিটা কিনতে চাইলেন।
আমি জিজ্ঞেস করলাম, হঠাৎ এইরকম একটা অতি সাধারণ জাহাজের ছবি কিনতে চাইছেন কেন?
মহিলাটি হেসে বললেন, এ ধরনের জাহাজের ছবি বড়ো একটা দেখা যায় না বলেই সংগ্রহ করতে চাই।
আমি তখন খুশি হয়ে তাকে জাহাজের গল্পটা বললাম। শুনে উনি এত দূর ভয় পেলেন যে আমার চোখের সামনেই তার মুখটা সাদা হয়ে গেল।
আমি ওকে ভরসা দিয়ে বললাম, আপনি ঘটনাটা শুনে ভয় পাচ্ছেন, আর আমি ভাবছি যদি আমার প্রচুর টাকা থাকত তাহলে একবার জাহাজে করে সেই জায়গাটায় গিয়ে সেই সমুদ্র-দানবের বিষয় অনুসন্ধান করতাম।
অনুসন্ধান করতেন! মহিলাটি চমকে উঠলেন।
হ্যাঁ, করতাম। করতাম কেন, এখনো করছি এখানে বসেই। সত্যিই সেদিন কি ঘটেছিল, কেন ঘটেছিল, সেরকম ঘটা সম্ভব কিনা এসব আমায় জানতেই হবে। জানতে পারলে আমি আধুনিক জগতের মানুষের কাছে তা প্রচার করব।
মহিলাটি জিজ্ঞেস করলেন, কিন্তু এখানে বসে কী করে আপনি অনুসন্ধান করবেন?
বললাম, আপনি বোধহয় খবর রাখেন না এখনও আমাদের দেশে এমন সব তান্ত্রিক আছেন যারা সারাজীবন এইসব অলৌকিক ব্যাপারের রহস্য সন্ধান করে যাচ্ছেন।
বললাম, আমি এমন ফকিরের কথা জানি যিনি ইচ্ছে করলে বেশ কিছুক্ষণের জন্যে নিজের আত্মাকে দেহমুক্ত করে সুদূর দেশ ঘুরে আসতে পারেন।
ভদ্রমহিলা অবাক হয়ে শুনতে লাগলেন।
আমি বললাম, আমার ঠাকুরদার বাবা তার ডায়েরিতে মিশর থেকে ছাপা একটা বইয়ের উল্লেখ করেছেন যাতে নাকি সেই সমুদ্র-দানবের কথা আছে। সেই বইয়ের সন্ধান করছি।
একটু থেমে বললেন, আমি ভদ্রমহিলাকে বুঝিয়ে দিলাম, আমার কোনো বন্ধন নেই, কাজেই নির্ভাবনায় অলৌকিক বিষয় অনুসন্ধানে নেমে পড়ব।
তারপর? বাপ্পা জিজ্ঞেস করল।
হ্যারিকাকু বললেন, মহিলাটি এই পর্যন্ত শুনে খুব ভয় পেয়ে গেলেন। আমাকে সাবধান করে দিলেন। ওসব বড়ো বিপজ্জনক কাজ, মিস্টার ইভেন্স।
আমি হেসে উঠে বললাম, আমার কাছে একটা মড়ার মাথার খুলি আছে। এত বড়ো খুলি যে মানুষের হতে পারে ভাবা যায় না। তাতে দুর্বোধ্য ভাষায় অনেক কিছু লেখা আছে। দেখবেন?
মহিলাটি শিউরে উঠে বললেন, না। আমার কোনো আগ্রহ নেই।
জিজ্ঞেস করলেন, সেটা পেলেন কোথায়?
বললাম, প্রেতাত্মার রহস্য সন্ধানে আমি নেপাল পর্যন্ত গিয়েছিলাম। সেখানে এক তিব্বতী লামার সাক্ষাৎ পাই। তিনি আমার সব কথা শুনে অনেক উপদেশ, পরামর্শ আর কীভাবে কী করলে সেই প্রেতাত্মার রহস্য জানা যাবে শিখিয়ে দিয়েছেন। তিনিই সেই খুলিটা দিয়েছিলেন। সঙ্গে দিয়েছিলেন লাল একটুকরো কাপড় আর কিছু কাঠের গুঁড়োর মতন।