…হ্যারিকাকু যখন দুহাত তুলে ঘটনাটা উত্তেজিতভাবে বলে যাচ্ছিলেন তখন তাকে কিরকম যেন লাগছিল। মনে হচ্ছিল তিনি যেন আর ইহজগতের মানুষ নন, ঘটনাস্থলও কলকাতার ইলিয়ট রোড নয়–যেন প্রায় ১২৫ বছর আগের এক ভয়াবহ সমুদ্রযাত্রীর ঘটনাটা চোখের সামনে ঘটছে।
আর ঠিক তখনই ঘরের বাইরে একটা চাপা গর্জন, যেন প্রচণ্ড ঘূর্ণিঝড় ছুটে আসছে..
ঝড় আছড়ে পড়ল কলকাতার বুকে। জানলার বাইরে একবার তাকালেন। আতঙ্ক জড়ানো স্বরে নিজের মনেই বলে উঠলেন, ঝড়!
বাপ্পা রঞ্জু দুজনেই অবাক হলো। ঝড় তো হতেই পারে। তার জন্যে এত ভয় পাবার কি থাকতে পারে? ততক্ষণে গোঁ গোঁ শব্দে ঝড় ঘরে ঢুকে পড়েছে। সব যেন চুরমার হয়ে যাবে। দেওয়ালে জাহাজের ছবিটা মাথা কুটছে। এই বুঝি পড়ে খানখান হয়ে যাবে।
হ্যারিকাকু কোনোরকমে উঠে দাঁড়ালেন।
ও ঘরের জানলাটা, বলতে বলতে উনি পর্দা সরিয়ে ভেতরে ঢুকে পড়লেন।
ঘরটায় সুইচ অফ করা ছিল। দু মিনিটও হয়নি, দড়াম করে একটা শব্দ–সঙ্গে সঙ্গে হ্যারিকাকুর আর্ত চিৎকার, বাঁ-চা-ও।
ছুটে গেল বাপ্পা আর রঞ্জু। এ ঘরটা কিরকম তা এরা জানে না। সুইচবোর্ডটাও যে কোথায় কে জানে। হাতে টর্চও নেই। কোথায় তিনি? অন্ধকারে কিছুই দেখা যাচ্ছে না।
কিন্তু হ্যারিকাকুর আর সাড়া পাওয়া যাচ্ছে না কেন?
বাপ্পা চেঁচিয়ে উঠল, হ্যারিকাকু–আঙ্কেল
হঠাৎই সেই অন্ধকারের মধ্যে কী যেন দেখল ওরা। একদলা সাদা কুয়াশা লম্বা হয়ে উঠছে..যেন কী একটা টানতে টানতে জানলা দিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছে।
রঞ্জু, টর্চটা-চেঁচিয়ে উঠল বাপ্পা।
কিন্তু কোথায় টর্চ?
এমনি সময়ে বিদ্যুৎ চমকালো। সেই আলোয় সুইচবোর্ডটা দেখে নিয়ে রঞ্জু ছুটে গিয়ে আলো জ্বালিয়ে দিল। দেখল গরাদহীন জানলায় হ্যারিকাকুর দেহের অর্ধেকটা ঝুলছে। অচৈতন্য।
প্রায় এক ঘণ্টা পর হ্যারিকাকু একটু সুস্থ হলে ওরা দুজন যখন রাস্তায় নেমে এল তখন কলকাতার আলোকোজ্জ্বল রাজপথে ঝড়ের দাপটের আর কোনো চিহ্নমাত্র নেই। ট্রাম চলছে, বাস চলছে, ট্যাক্সি ছুটছে। অথচ এই কিছুক্ষণ আগে এই কলকাতার বুকেই যে অদ্ভুত ঘটনাটা ঘটে গেল তা কেউ জানতে পারল না।
ব্যাপারটা ওরা বাড়িতে কাউকে বলল না। প্রথমত, কেউ বিশ্বাস করবে না। দ্বিতীয়ত, ঐসব জায়গায় সন্ধের পর ছেলেমানুষদের যাওয়া রঞ্জুর বাবা মোটেই পছন্দ করেন না।
বাপ্পা পরের দিনই দেশে ফিরে গেল। কলকাতায় প্রায় এক সপ্তাহ ছিল। আর থাকা যায় না। যাবার সময়ে আড়ালে রঞ্জুকে বলে গেল, ব্যাপারটা আমায় খুব ভাবিয়ে তুলেছে। আমি শিগগিরই আবার আসব। তখন আবার হ্যারিকাকুর ওখানে যাব। অনেক রহস্য আছে।
দু-পা গিয়ে ফিরে এসে বলল, হ্যাঁ, শোন এ নিয়ে কাউকে কিছু বলবি না। আর ভুলেও কখনো ওখানে একলা যাবি না।
.
০৫.
হ্যারিকাকুর পূর্ব অভিজ্ঞতা
মাস তিনেক পরে এক রবিবার বেলা দশটা নাগাদ হ্যারিকাকুর বাড়িতে ওরা বসেছে। হ্যারিকাকু এখন বেশ সুস্থ। স্বাভাবিক। আজও উনিই বক্তা। সেদিনের ঘটনা সম্বন্ধে উনি বেশ খুশমেজাজেই বললেন, কী যে হলো আমি নিজেই তা ঠিক বুঝে উঠতে পারিনি। ঝড় তো আগেও হয়েছে। কিন্তু এমন ভয় পাইনি কখনো। তারপর যখন ও ঘরে জানলা বন্ধ করতে গেলাম তখনই দেখলাম জানলার মধ্যে দিয়ে ঝড়ের সঙ্গে এক দলা কুয়াশার মতো কী যেন ঘরে ঢুকছে। সইচ অন করবার আগেই হঠাৎ মনে হলো আমার দম বন্ধ হয়ে আসছে। তারপর আর কিছু মনে নেই। তোমরা ঘরে গিয়ে কী দেখলে?
রঞ্জু বেশ উত্তেজিতভাবেই কিছু বলতে যাচ্ছিল, বাপ্পা ইঙ্গিতে থামিয়ে দিয়ে বলল, আলো জ্বালতেই দেখলাম আপনি জানলার ধারে পড়ে রয়েছেন।
জানলার ধারে। হ্যারিকাকু চমকে উঠলেন।
হ্যাঁ।
কিন্তু আমি তো জ্ঞাতসারে ওদিকে যাইনি। বলে নিজেই ভাবতে লাগলেন। আর সেই ভাবনার সঙ্গে সঙ্গে তার মুখটা যে কিরকম ঝুলে যাচ্ছিল বাপ্পার তা নজর এড়াল না। তবু তো বাপ্পা বুদ্ধি করে জানলার বাইরে অর্ধেক দেহ ঝুলছিল বলেনি।
আচ্ছা, তোমরা আর কিছু দেখোনি?
সত্যি কথা বলার জন্যে রঞ্জুর মন ছোঁক ছোঁক করছিল। সে চকিতে একবার বাপ্পার দিকে তাকাল। বাপ্পা তাকে চোখের ইশারায় নিরস্ত করে বলল, কই না তো।
কিন্তু আমি কিছু একটা দেখেছিলাম। সাদা একটা কিছু মানুষের মতো
সে হয়তো আপনার চোখের ভুল।
হ্যারিকাকু অন্যমনস্কভাবে বললেন, কী জানি।
আচ্ছা হ্যারিকাকু, এর আগে এরকম আর কখনো ঘটেনি?
না।
ভালো করে মনে করে দেখুন তো!
হ্যারিকাকু চিন্তিতভাবে মাথা নাড়লেন।
হ্যারিকাকু, হয় আপনি ভুলে যাচ্ছেন, নইলে ছেলেমানুষ বলে আমাদের কাছে বলতে চাইছেন না। কিন্তু কেন? আমরা তো আপনার কাছে গল্প শুনতেই এসেছি। আর সে গল্প যদি আপনার মতো বহুদর্শী মানুষের নিজের অভিজ্ঞতা হয় তাহলে তো কথাই নেই।
হ্যারিকাকু তবু মাথা নেড়েই যাচ্ছেন।
না হে, না। এরকম ঘটনা আর ঘটেনি।
কোনো অশরীরীর আবির্ভাব?
হ্যারিকাকু শুকনো গলায় বললেন, না না-না।
যদি নাই হবে তাহলে ঘরের চারদিকে এত সচিহ্ন কেন? কেউ তো শখ করে এত ক্রুস এঁকে ঘরের শোভা বাড়ায় না।
হঠাৎ হ্যারিকাকু যেন ফুটো বেলুনের মতো চুপসে গেলেন। বললেন, হ্যাঁ, ঠিকই ধরেছ। কিছু একটা প্রায়ই ঘটে। আর তা অনেক দিন ধরেই।
কীরকম দয়া করে একটু বলুন না।