খেয়াল যখন হলো তখন বেলা দুপুর। খাবার টেবিলে দেখা গেল একটা মিল বেশি হচ্ছে। অর্থাৎ একজন প্যাসেঞ্জার নেই।
রেজিস্টার হাতে নিয়ে কাপ্তেন সবাইকে লাইন করে দাঁড় করিয়ে নাম ডাকলেন। সবাই সাড়া দিল। দিল না শুধু একজন।
সেই একজন কোথায় গেল? সে তো গভীর সমুদ্রে নেমে বেড়াতে যেতে পারে না। মজা করে লুকোচুরিও খেলবে না।
তাহলে?
কাপ্তেন হুকুম দিলেন জাহাজের অলিগলি, ফাঁক-ফোকর সব খুঁজে দেখতে। বলা যায় না যদি কোথাও অসুস্থ হয়ে পড়ে থাকে।
কিন্তু না–কোথাও তাকে পাওয়া গেল না। এক অজানা ভয়ে যাত্রীদের বুক দুরুদুরু করে উঠল।
এই পর্যন্ত বলে হ্যারিকাকু থামলেন। কেমন যেন একটু অন্যমনস্ক হয়ে গেলেন। উঠে গিয়ে জানলার পর্দাটা সরিয়ে আকাশের দিকে তাকালেন। তখন বেশ রাত হয়েছে। উঁচু উঁচু বাড়িতে আলো জ্বলছে। রাস্তাতেও আলো ঝলমল করছে। কেমন একটা গুমোট ভাব। তিনি যেন একটু চিন্তিত মুখে আবার চেয়ারে এসে বসলেন।
তারপর? উৎসুক আগ্রহে বাপ্পা জিজ্ঞেস করল।
হ্যারিকাকু মুহূর্তে নিজেকে সামলে নিয়ে বললেন, লোকটিকে যখন কোথাও পাওয়া গেল না তখন সিদ্ধান্ত হলো, নিশ্চয় ঝড়ের সময় অন্ধকারে তাড়াতাড়ি উঠে আসতে গিয়ে জলে পড়ে গিয়েছে।
কথাটা সবাই মেনে না নিলেও বেশির ভাগ প্যাসেঞ্জারই বলল, তাই হবে। যা ঝড় উঠেছিল মনে হচ্ছিল সবাইকে বুঝি সমুদ্রে উড়িয়ে নিয়ে যাবে।
জাহাজ লোহিত সাগর দিয়ে ক্রমেই সুয়েজের দিকে ঝিকঝিক করে এগোচ্ছে। পরের দিনও, রাত্রে ঠিক একই সময়ে ঝড় উঠল। সবাই হুড়মুড় করে ভেতরে গিয়ে ঢুকল। তারপর সকালে দেখা গেল আর একজন নেই।
দ্বিতীয় জনটিও কি ঝড়ের সময়ে ডেক থেকে পড়ে গেছে? তা কী করে সম্ভব? বিশেষ করে যখন সকলেরই আগের দিনের অ্যাকসিডেন্টের কথা মনে আছে।
এবার সবাই রীতিমতো আতঙ্কিত। সবাই কাপ্তেনকে ঘিরে ধরল, এটা কী হচ্ছে?
কাপ্তেন আর কি করবেন? তিনি নিজেও খুব চিন্তিত। বললেন, আমিও তো আপনাদের সঙ্গেই রয়েছি। আপনাদের মতোই বিভ্রান্ত। তবু দেখছি–
জাহাজে একজন খুব সাহসী যুবক ছিলেন। নাম জোসেফ জোসেফ ইভেন্স (নামটা শুনেই বাপ্পা একটু নড়েচড়ে বসল)। তিনি কাপ্তেনকে এসে গোপনে কয়েকটি কথা বললেন। শুনে কাপ্তেনের দু-চোখ ঠেলে বেরিয়ে আসার উপক্রম। বললেন, এ যে অসম্ভব কথা মিস্টার ইভেন্স!
জোসেফ ইভেন্স গম্ভীরভাবে বললেন, না, অসম্ভব নয়। আমি কায়রো থেকে পাবলিশ করা একটা বইয়ে ঠিক এইরকম ব্যাপারের কথা পড়েছি। তা ছাড়া গত রাতে ঝড়ের সময় মুহূর্তের জন্যে আমার চোখেও কিছু অবিশ্বাস্য দৃশ্য ধরা পড়েছিল। সে বিষয়ে আমি এক্ষুনি নিশ্চিত করে কিছু বলছি না। আমারও ভুল হতে পারে। তবে আজ রাত্রেও যদি ঝড় ওঠে তাহলে আমি প্রস্তুত থাকব।
কাপ্তেন বললেন, মিস্টার ইভেন্স, আপনার এই সৎসাহসের জন্যে ধন্যবাদ। আমিও সজাগ থাকব।
পরের দিন সকাল এল একটা বিমর্ষ দুর্ভাবনার বোঝা নিয়ে। আজও সকালে প্রভাতী চায়ের কাপ হাতে নিয়ে যাত্রীরা আলোচনা করতে লাগল গত রাত্রের কথা। কিছুতেই তারা ভেবে পায় না কী হতে পারে। শুধু জোসেফ ওদের মধ্যে থাকলেন না। তিনি ডেকের চারদিক ঘুরে দেখতে লাগলেন। এক সময়ে কাপ্তেন পাশে এসে দাঁড়ালেন। নিচু গলায় জিজ্ঞেস করলেন, মিস্টার ইভেন্স, কি দেখছেন?
ইভেন্স বললেন, ঝড়ে উড়িয়ে নিয়ে যাওয়া ছাড়া আর কোনো চিহ্ন কোথাও আছে কিনা!
পেলেন কিছু?
না।
.
রাত্রি হলো।
যাত্রীরা কেউ আর ডেকে শুতে চায় না। অথচ ভেতরে যে শোবে সেরকম জায়গা, নেই। তার ওপরে গরম। সারারাত ঘুম হবে না। অগত্যা তারা কেউ শ্রীহরির, কেউ আল্লার, কেউ বুকে অদৃশ্য ক্রুস এঁকে ডেকেই শুলো। কিন্তু কিছুতেই দু-চোখের পাতা এক করতে পারছিল না।
তবু একসময়ে তারা ঘুমিয়ে পড়ল।
রাত তখন একটা বেজে চল্লিশ মিনিট। জোসেফ ইভেন্স ঠায় বসে আছেন তাঁর কেবিনে। ঝড়টা ওঠে রাত দুটো নাগাদ। তিনি ঐ সময় পর্যন্ত জেগে থাকবেনই। তাহলে আর কুড়ি মিনিট। তিনি কেবিনে বসে আছেন। লক্ষ তাঁর খোলা জানলা দিয়ে আকাশের দিকে। ওপরে অন্ধকার আকাশ, নিচে গাঢ় নীল জল। ইভেন্স আকাশের গায়ে তারা দেখে বুঝলেন, পরিষ্কার আকাশ। তাহলে বোধহয় আজ আর তেমন কিছু ঘটবে না।
দশ মিনিট পর তিনি দেখলেন আকাশের তারাগুলো অদৃশ্য হয়েছে। সঙ্গে সঙ্গে তিনি খাড়া হয়ে বসলেন। মেঘ করছে। তাহলে আজও ঝড় আসছে। আশ্চর্য! পরপর তিন দিন একই সময়ে ঝড়!
ভাবতে ভাবতেই গোঁ গোঁ করে একটা প্রচণ্ড ঝড়ের ধাক্কায় জাহাজটা দুলে উঠল। বড়ো বড়ো ঢেউ আছড়ে পড়ল জাহাজের গায়ে। সঙ্গে সঙ্গে ডেকের যাত্রীদের মধ্যে চিৎকার চেঁচামেচি, হুটোপাটি। তারা ডেক ছেড়ে ভেতরে ছুটে আসছে।
মুহূর্তমাত্র দেরি না করি জোসেফ ইভেন্স কেবিন থেকে বেরিয়ে ডেকের দিকে ছুটলেন। এক হাতে তার টর্চ, অন্য হাতে গুলিভরা পিস্তল।
তিনি ডেকের কাছে যেতেই আতঙ্কে দু-পা পিছিয়ে এলেন। দেখলেন সাদা চাদরের মতো কিছু একটা জড়ানো বিশাল একটা মূর্তি সমুদ্র থেকে উঠে বরফের মতো সাদা পা ডেকের উপর তুলেছে। দুখানা তুষারঝরা হাত এগিয়ে আসছে একজন যাত্রীকে ধরার জন্যে।
সঙ্গে সঙ্গে ইভেন্স পরপর দুবার গুলি ছুড়লেন। কিন্তু কিছুই হলো না। ততক্ষণে হাতখানা প্রায় ধরে ফেলেছে যাত্রীটিকে। ইভেন্স টর্চ পিস্তল ফেলে দিয়ে মরিয়া হয়ে একেবারে মূর্তিটার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়লেন। মুহূর্তেই অদ্ভুত ব্যাপার ঘটে গেল। একটা বিকট শব্দ করে সেই অশরীরী দানবটা শিকার ছেড়ে দিয়ে ডেক থেকে সমুদ্রে লাফিয়ে পড়ে হারিয়ে গেল।