বাপ্পা চুপ করে রইল।
আর কিছু জিজ্ঞেস করার আছে?
আপনি কি এখানে একাই থাকেন?
শুধু এখানে বলে নয়। ইহজগতে আমার কেউ নেই একমাত্র যিশু ছাড়া।
এই পুরনো ভাঙাচোরা বাড়িতে আপনি কতদিন আছেন?
বহুদিন।
এ বাড়িতে থাকতে আপনার ভালো লাগে?
ভালো লাগা-না-লাগা বুঝি না। অভ্যস্ত হয়ে গেছি। অসুবিধে হয় না।
কিন্তু এ বাড়িতে থাকা তো risky. ভূমিকম্প হলে
কী আর করা যাবে!
অন্য কোথাও
অসম্ভব। কোথায় বাড়ি পাব? অত টাকাই বা কোথায়? তা ছাড়া পাঁচজনের সঙ্গে থাকা আমার অভ্যেস নয়।
বাপ্পা তৎক্ষণাৎ বলল, সেইজন্যই বোধহয় আপনার ঘরে ঐ একখানি চেয়ার ছাড়া আর কোনো চেয়ার নেই? লোক-আসা আপনি পছন্দ করেন না?
বাপ্পার এই ধরনের প্রশ্ন রঞ্জুর মোটেই ভালো লাগছিল না। তার মনে হচ্ছিল, বাপ্পা যেন পুলিশের মতো জেরা করছে। ও তো হ্যারিকাকুকে চেনে না। এখুনি যদি রেগে যান তাহলে আর কোনোদিন তাদের মুখদর্শন করবেন না।
রঞ্জু তাই লুকিয়ে বাপ্পাকে চিমটি কেটে থামতে ইঙ্গিত করল। কিন্তু বাপ্পা গ্রাহ্যই করল না।
হ্যারিকাকু, আমার কেমন মনে হয় আপনি খুব ডিস্টার্বড়। কিছু যেন খুঁজে বেড়াচ্ছেন এমন কিছু যা সহজে পাওয়া যায় না। তাই কি?
এ কথায় হ্যারিকাকু খুব গম্ভীর হয়ে গেলেন। একটু চুপ করে থেকে বললেন, সেটা আমার খুব পার্সোনাল ব্যাপার। কাউকেই বলব নয়–তোমাদের মতো বাচ্চাদের তো নয়ই।
ঠিক আছে। জানতে চাই না। আমি শুধু আর একটা কথা জিজ্ঞেস করব। যদি অনুমতি দেন
বলো।
আপনার ওপর আমার যে সত্যিই কৌতূহল আছে, মাত্র একদিন দেখে আপনি কী করে বুঝলেন?
এ কথায়, বর্ষার থমথমে মেঘের মধ্যে হঠাৎ যেমন এক চিলতে রোদ ঝিলিক দিয়ে যায়, হ্যারিকাকুর থমথমে মুখে তেমনি এক ফালি হাসি ফুটল। বললেন, তোমার চোখ দেখে। প্রথম দিনই তুমি আমায় খুব লক্ষ করেছিলে। আমার ওপর তোমার এতদূর কৌতূহল যে আমায় ফলো পর্যন্ত করেছিলে। তাই না?
হ্যারিকাকুর এ কথা শুনে দুজনেই চমকে উঠল। আশ্চর্য! এই বয়েসেও হ্যারিকাকু এত সতর্ক।
হ্যারিকাকু গম্ভীরভাবে বললেন, এরপর নিশ্চয়ই জানতে চাইবে কোন বইটার খোঁজ করছিলাম?
বাপ্পা বলল, জানতে ইচ্ছে করে। তবু না জানলেও ক্ষতি নেই। বইটা দুষ্প্রাপ্য, পুরনো। নিশ্চয়ই তাতে এমন কোনো তথ্য আছে যা জানার জন্যে আপনি যে কোনো দাম দিতে চান। কী সেই তথ্য? আমার মনে হয় ঐ জাহাজের সঙ্গে সেই তথ্যের কোনো সম্পর্ক আছে। আর সেটা যে কোনো গুপ্তধন উদ্ধারের ব্যাপার সেটা বুঝতে পারি–আপনার ঘরে এই যে এত ক্রুস রয়েছে তাই দেখে। আপনি চারদিকে ক্রুস এঁকে যেন কোনো বিশেষ। ভয় থেকে নিজেকে রক্ষা করতে চাইছেন!
শুনতে শুনতে হ্যারিকাকুর মুখটা ফাঁক হয়ে গেল। তিনি মুগ্ধ হয়ে বললেন, তোমার বুদ্ধি, সূক্ষ্ম দৃষ্টি, অনুমান করার শক্তি দেখে আমি মুগ্ধ হচ্ছি। তুমি যা বলেছ তা হান্ড্রেড পার্সেন্ট কারেক্ট।
একটু থেমে বললেন, তুমি যখন এতদূর জেনে ফেলেছ, তখন যে ঘটনার জন্যে আমি সত্যি সত্যিই ডিস্টার্বড়–যার রহস্য সন্ধানের জন্যে আমি মরিয়া হয়ে উঠেছি–যে ঘটনা কাউকে বলার নয়, তাই আজ তোমাদের বলব। ঘটনাটা শুনতে শুনতে একটু রাত হলে তোমাদের অসুবিধে নেই তো?
দুজনেই বলে উঠল, না, কোনো অসুবিধে নেই।
ঘটনাটা ঘটেছিল বহুকাল আগে। কলকাতাতে তো নয়ই–বহু দূরে–ভারতবর্ষের বাইরে। কিন্তু তার জের বোধহয় এখনো মেটেনি। হয়তো আমিই নির্বোধের মতো জের টেনে চলেছি। দাঁড়াও। আগে একটু কফি করে আনি।
বলে হ্যারিকাকু টেবিল ধরে উঠে দাঁড়িয়ে পর্দা সরিয়ে পাশের ঘরে চলে গেলেন।
.
০৪.
অশরীরী দানবের হানা
কফি খেতে খেতে হ্যারিকাকু তার কাহিনি শুরু করলেন। সে কাহিনি এইরকম :
১৮৪৪ সালে ইন্ডিয়া থেকে ইংলন্ডে যাবার প্রথম জাহাজ চালায় P & 0 কোম্পানি। তখন ইংলন্ডে যেতে হলে কলকাতা থেকে মাদ্রাজ ও সিংহল হয়ে লোহিত সাগরের ভেতর দিয়ে সুয়েজ। সুয়েজ থেকে স্থলপথে মরুভূমি পার হয়ে কায়রো। নীলনদ দিয়ে স্টিমারে চড়ে আলেকজান্দ্রিয়া। তারপর মাল্টা, নেস, রোম, ফ্লোরেন্স, ভেনিস, জার্মানির বিভিন্ন শহর পার হয়ে ইংলিশ চ্যানেল ক্রস করে লন্ডন।
কবছর পর কলকাতা থেকে ঐ P & 0 কোম্পানির জাহাজ বেন্টিঙ্ক ছাড়ল। আকারে বড়ো হলেও জাহাজটায় অব্যবস্থার চূড়ান্ত। মোটামুটি আশিজন যাত্রী ধরে। মাত্র ছটি কেবিন। এ কেবিন কটি ছাড়া আর যে সমস্ত জায়গায় থাকার ব্যবস্থা ছিল তা বসবাসের অযোগ্য। সব যেন ইঁদুরের গর্ত। যেমনি সংকীর্ণ, তেমনি নোংরা। আলো, বাতাসের বালাই নেই। এই যাত্রীদের বেশির ভাগকেই ডেকে সারাদিন সারারাত্রি কাটাতে হতো।
সেদিনও রাত্রে একদল যাত্রী পাশাপাশি ডেকে শুয়েছে। জাহাজটা তখন ইন্ডিয়ান ওশেন ছাড়িয়ে সবে লোহিত সাগরে ঢুকেছে। জাহাজের ডেকে বাতাস খুব। কিন্তু বাতাসটা যেন বেশ ভারী আর গরম।
ডেকের যাত্রীরা তবুও বেশ আরাম করেই ঘুমোচ্ছিল, মাঝরাতে হঠাৎ উঠল দারুণ ঝড়। যে ঝড়ের কোনো পূর্বাভাস ছিল না। যাত্রীরা ডেক থেকে ছুটে যে যেখানে পারল ইঁদুরের গর্তে ঢুকে পড়ল।
ঝড় বেশিক্ষণ থাকেনি। ভোর হলো। নীল সমুদ্রের বুক থেকে লাফিয়ে উঠল নতুন দিনের লাল সূর্য। সবাই খুশি মনে প্রাতঃকালীন চা নিয়ে বসল। কেউ খেয়াল করল না– যারা ডেকে শুয়েছিল তাদের মধ্যে একজন নেই।