না, ডাকিস না। তার চেয়ে চ দূর থেকে ওঁর পিছু পিছু যাই।
কেন? রঞ্জু একটু অবাক হলো।
বাপ্পা হেসে বলল, ওঁকে একটু চমকে দেব।
রঞ্জু একটু থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল।
তোর মতলবটা কি বল্ দিকি? তোকে তো অনেক দিন থেকেই চিনি। কোনো রহস্যের গন্ধটন্ধ
বাপ্পা হেসে ওর পিঠ চাপড়ে বলল, পাগল নাকি! একে বুড়ো, তার ওপর কলকাতার মানুষ, তা ছাড়া ভালো করে আলাপই জমল না, ওঁর মধ্যে রহস্য খুঁজে পাব কি করে? নে জোরে হাঁট। ঐ যাঃ! কোথায় হারিয়ে গেলেন?
রঞ্জু আঙুল তুলে বলল, ঐ তো ঐ ঝকাওয়ালার পেছনে।
দুজনে ফুটপাথ ক্রস করে একেবারে হ্যারিকাকুর পিছনে এসে পড়ল।
আরও মিনিট দশেক চলার পর হ্যারিকাকু ওয়েলেসলির মোড়ে যেখানে ফুটপাথে একজন মুসলমান পুরনো বই বিক্রি করছিল সেখানে এসে থামলেন।
হ্যারিকাকুকে দেখে বইওলা বলল, না সাহেব, বইটা এখনো আসেনি।
হ্যারিকাকু যেন একটু হতাশ হলেন। হ্যাটটা খুলে রুমাল দিয়ে মুখ মুছলেন।–সত্যি করে বলো তো ইসমাইল, বইটা পাওয়া যাবে তো?
ইসমাইল বলল, আমি তো মুম্বায়েও খোঁজ করেছি। ওরা তো বলেছে, সামনের লটে যে সমস্ত বই আসবে তার মধ্যে আপনার বইটা থাকবে।
ওরা বইটার নাম করে বলেছে তো, না আন্দাজে?
ইসমাইল বলল, আপনি তো লিখে দিয়েছিলেন। সেই সিলিপটাই পাঠিয়ে দিয়েছি। বলছে কায়রোতে ছাপা অত পুরনো বই পাওয়া কঠিন। তবু খোঁজ পেয়েছে।
হ্যারিকাকু যেন এক বিন্দু আশার আলো দেখলেন। বললেন, তোমায় তো বইটার জন্যে কিছু টাকা অ্যাডভান্স করেছি, আর কিছু দেব?
দরকার হবে না।
হ্যারিকাকু বললেন, বইটা আমার খুব তাড়াতাড়ি দরকার। বয়েস হয়ে গেছে। কোন দিন মরে যাব কিংবা রোগে পড়ে থাকব। তাহলে আর আক্ষেপের শেষ থাকবে না।
ইসমাইল বলল, বইটা পেলে আমি আপনার বাসায় দিয়ে আসব।
থ্যাঙ্ক ইউ ইসমাইল। বলে উনি ফিরলেন। আর তখুনি বাপ্পা রঞ্জুর হাতটা টেনে নিয়ে স্যাঁৎ করে একপাশে সরে গেল।
হারিকাকু বেশ কিছুদূর চলে গেলে রঞ্জু বলল, এত দূর ওঁর পিছু পিছু এসে কিছু লাভ হলো?
বাপ্পা হেসে বলল, হলো বৈকি!
কীরকম?
ঘরে একখানি বইয়ের চিহ্নও নেই, তবু বিশেষ একখানি বইয়ের জন্যে তিনি পাগল হয়ে উঠেছিলেন। কী এমন সেই বই? ঘরের চারদিকে ক্রুস চিহ্ন। খুব বড়ো পাদ্রীর ঘরেও এত ক্রুসের ছড়াছড়ি থাকে না। পুরনো চিত্রকলায় টেস্ট আছে বলে মনে হয় না, তবু তাঁরই ঘরের দেওয়ালে পুরনো কালের জাহাজের ছবি!
একটু থেমে বলল, তুই বলেছিলি হ্যারিকাকু বড়ো অদ্ভুত মানুষ। এখন মনে হচ্ছে উনি শুধু অদ্ভুতই নন, রহস্যময়ও বটে।
.
০৩.
সে কালের জাহাজের ছবিটা কেমন
এক মাস পর।
তখন সন্ধে হয়নি। সরু গলি আর ঘেঁষাঘেঁষি চাপা বাড়ি বলেই বোধহয় অন্ধকার হয়ে এসেছিল। বাপ্পা আর রঞ্জু বসেছিল ক্যাম্প-খাটে। আর চেয়ারে বসেছিলেন হ্যারিকাকু।
বাপ্পার ইচ্ছে ছিল না এইরকম অবেলায় হ্যারিকাকুর কাছে আসার। সে মফঃস্বলের ছেলে। কলকাতার রাস্তাগুলো চেনে না। তাই সন্ধে হয়ে গেলেই বাপ্পার অস্বস্তি হয়, যদি পথ হারিয়ে ফেলে। ভরসা–সঙ্গে রঞ্জু আছে। সে কলকাতার ছেলে, বড় হয়েছে, অনেক রাস্তাই চেনে। ও-ই বলল, হ্যারিকাকুর কাছে গল্প শুনতে হলে সন্ধেবেলাই ঠিক সময়। নইলে কটকটে রোদে ওঁর গল্প শুনে আরাম হয় না।
হ্যারিকাকুর ছিনে লম্বা গলা থেকে হর্ন বাজার মতো কণ্ঠস্বর শোনা গেল, কি জানতে চাও বলো।
বাপ্পার দিকে তাকিয়েই তিনি যেন কথাগুলো ছুঁড়ে মারলেন।
রঞ্জু তাড়াতাড়ি বলল, ও কিছু জানতে চায় না হ্যারিকাকু। ওকে এনেছি আপনার কথা শোনাবার জন্যে।
হ্যারিকাকু গম্ভীরভাবে বললেন, না, রবিনসন, আমায় নিয়ে ওর খুব কৌতূহল।
রঞ্জুকে রবিনসন বলে ডাকতে বাপ্পা দুবার শুনল।
হ্যাঁ, আমায় নিয়ে ওর খুব কৌতূহল। তাই আগে ওর কৌতূহল মেটাতে চাই। বলো ইয়ং ডিটেকটিভ, কী জানতে চাও?
বাপ্পা অবাক হলো। সত্যিই যে ওঁর ওপরে তার একটু বিশেষ কৌতূহল আছে, মাত্র প্রথম দিনের মিনিট পনেরো দেখাতেই কি করে উনি বুঝলেন!
যাই হোক, সে কথা চেপে গিয়ে বাপ্পা বলল, ঐ জাহাজের ছবিটা আপনি টাঙিয়ে রেখেছেন কেন?
এটা কি একটা বুদ্ধিমান ছেলের প্রশ্ন হলো? হ্যারিকাকু যেন বিরক্ত হয়েই বললেন। ছবিটা ছিল। ফেলে না দিয়ে টাঙিয়ে রেখেছি। Whats wrong?
বাপ্পা বুঝল হ্যারিকাকুর মেজাজটা খিঁচড়ে আছে–বোধহয় তার ওপরেই। তবু ঘাবড়ে না গিয়ে বলল, তা নয়। আসলে জাহাজটা সেই যুগের যখন স্টিমের জাহাজ প্রথম চালু হয়। সেই জাহাজের ছবি
হ্যারিকাকুর কাঁচা-পাকা ভুরু দুটো কাছাকাছি হলো। তিনি একটু অবাক হলেন। বললেন, ছবিটা দেখে বুঝলে কী করে যে এটা প্রথম যুগের জাহাজ?
রঞ্জুদের লাইব্রেরিতে একটা ইংরেজি ম্যাগাজিনে এইরকম কিছু ছবি দেখেছিলাম।
I see.
একটু থেমে বললেন, হ্যাঁ, এটা সেই সময়েরই ছবি।
এ ছবিটা আপনি পেলেন কি করে? এ কি কিনতে পাওয়া যায়? আর কেনই বা এটা যত্ন করে বাইরের ঘরে টাঙিয়ে রেখেছেন?
হ্যারিকাকু কিছুক্ষণ চুপ করে কী ভাবলেন। তারপর বললেন, না, এ ছবি কিনতে পাওয়া যায় না। অন্তত আমার চোখে পড়েনি। ছবিটা একটা পুরনো কাঠের বাক্সে পেয়েছি। সম্ভবত আমার ঠাকুর্দা রেখেছিলেন।
কিন্তু এটা টাঙিয়ে রেখেছেন কেন?
বাঃ! ঠাকুর্দার আমলের ছবি। ফেলে দেব?