রঞ্জু হেসে বলল, ওসব নয়। ওকে এনেছি আপনার কাছ থেকে গল্প শোনবার জন্যে। ও ভূতটুত একেবারে মানে না। কিন্তু আপনি আমায় যেসব অলৌকিক গল্প বলেছেন–বিশেষ করে পার্ক স্ট্রিটের বেরিয়াল গ্রাউন্ডের কাছে আপনার নিজের দেখা–ওকে একবার শুনিয়ে দিন তো।
এ কথায় হঠাৎ কেন যে তিনি এত গম্ভীর হয়ে গেলেন তা বোঝা গেল না।
গম্ভীর হয়েই তিনি খোলা জানলা দিয়ে তাকিয়ে রইলেন। সামনে যে দুটি কিশোর বসে আছে সে খেয়ালও বুঝি নেই।
বাপ্পার মনে হলো তাকে যেন হ্যারিকাকুর পছন্দ হয়নি। তার আর থাকতে ইচ্ছে করছিল না। ওঠার জন্যে উসখুস করছিল, এমনি সময় হ্যারিকাকু উঠে পর্দা সরিয়ে পাশের ঘরে ঢুকে গেলেন।
বাপ্পা তাকাল রঞ্জুর দিকে। রঞ্জু ঠোঁট ওল্টাল। অর্থাৎ সেও ঠিক বুঝতে পারছে না হ্যারিকাকুর আচরণটা ঠিক কিরকম।
বাপ্পা এবার ঘরটা দেখল। চৌকো, ছোট্ট ঘর। একজন মানুষেরই উপযুক্ত। সে আমলের সাহেবদের বাড়ির জানলার মতো গরাদহীন জানলা। রঙওঠা নীল রঙের পর্দা জানলায়। সেই জানলার দিকে পিছন করে হ্যারিকাকু বসে থাকেন কুশনআঁটা চেয়ারে। চেয়ারের সামনে বহু পুরনো একটা টেবিল। টেবিলে দোয়াতদানি, কলম, খুব মোটা একটা ফাউন্টেন পেন, একটা মোষের শিঙের পিঠ চুলকোবার ছড়ি। হিজিবিজি কাটা ছুরি পেপার-ওয়েট চাপা কাগজ। আর পুরনো হলেও খুব সুন্দর কাজ করা একটা ফ্লাওয়ার ভাস। তাতে একটা লাল গোলাপ।
ঘরের একপাশে একটা ক্যাম্প খাট। তাতে রানী রঙের ময়লা চাদর, আর দুটো বালিশ।
ওরা কোনোরকমে বসেছিল ক্যাম্প খাটটায় পা ঝুলিয়ে। ঘরে আর কোনো বসার জায়গা নেই।
বাপ্পার চোখ পড়ল সামনে দেওয়ালে। একটা সাদা কাগজে বড়ো বড়ো করে লেখা, Be one with Him : তার সঙ্গে একাত্ম হও।
তোর হ্যারিকাকু কি করে রে?
ঠিক জানি না। তবে আগে চার্চে পিয়ানো বাজাতেন বলে শুনেছি।
ঘরটা অপরিচ্ছন্ন। দেওয়ালে যিশুখ্রিস্টের ক্রুসবিদ্ধ ছবি, পাশেই কাঠের একটা ক্রুস ঝুলছে। আর ওদিকের দেওয়ালে ফ্রেমে বাঁধানো মস্ত একটা জাহাজের ছবি। জাহাজটা উত্তাল সমুদ্রে ভাসছে।
এরকম জাহাজের ছবি দেখা যায় না। বাপ্পা উঠে ছবিটার কাছে গিয়ে দাঁড়াল। রঞ্জুদের লাইব্রেরিতে একটা ইংরেজি ম্যাগাজিনে এইরকম জাহাজের ছবি দেখেছিল। স্টিমচালিত প্রথম যুগের জাহাজ। চিমনি থেকে গলগল করে ধোঁওয়া বেরোচ্ছে। এইরকম একটা পোকায় কাটা পুরনো যুগের জাহাজের ছবি বাইরের ঘরে টাঙিয়ে রাখার কারণ কী?
বাপ্পা নিজের মনেই হাসল। বড্ড বেশি অকারণ কৌতূহল। পুরনো কালের ছবি তো অনেক শিল্পরসিকই পছন্দ করে। তবে?
পরক্ষণেই মনে হলো, হ্যারিকাকুকে প্রথম দর্শনে যা মনে হয় তাতে তিনি যে একজন যথার্থ শিল্পরসিক তা ভাবা যায় না।
তাহলে?
এমনি সময়ে পাশের ঘরে চটির ফটাস ফটাস শব্দ। বাপ্পা তাড়াতাড়ি তার জায়গায় এসে বসল।
হ্যারিকাকু দুহাতে দুকাপ কফি নিয়ে ঘরে ঢুকলেন। প্লেটও জোটেনি। টেবিলের ওপর কাপ দুটো রেখে বললেন, খেয়ে নাও। আমি একটু বেরোব। বলেই তিনি আবার পর্দার আড়ালে চলে গেলেন।
নিঃশব্দেই দুজনে কফি খেয়ে নিল। বাপ্পা কফি খেয়েই উঠে দাঁড়াল।
নে ওঠ।
দাঁড়া, উনি আসুন।
কিন্তু বাপ্পার আর তর সইছিল না। এখান থেকে চলে যেতে পারলেই বাঁচে।
এমনি সময়ে হ্যারিকাকু একটা কালো প্যান্ট, আধময়লা আস্তিন গোটানো শার্ট আর মাথায় হ্যাট চাপিয়ে বেরিয়ে এলেন। হাতে একটি ছড়ি।
তোমরা উঠছ? ঠিক আছে। আর একদিন এসো।
হ্যারিকাকুর এইটুকু সৌজন্যেই বোধহয় ওরা দুজনে কৃতার্থ হয়ে গেল।
ঘর থেকে ওরা বেরোতেই হ্যারিকাকু দরজা বন্ধ করে দিলেন।
রাস্তায় নেমে রঞ্জু বলল, আমার খুব খারাপ লাগছে রে। তোর সঙ্গে কাকু মোটেই ভালো ব্যবহার করলেন না।
বাপ্পা কোনো উত্তর না দিয়ে ফুটপাথ ধরে হাঁটতে লাগল।
তুই বোধহয় আর কখনো এখানে আসবি না!
বাপ্পা হাসল এবার। বলল, কেন আসব না? আসতেই হবে। তোর হ্যারিকাকুকে খুব ইনটারেস্টিং লেগেছে।
.
০২.
বাপ্পার গোয়েন্দাগিরি
ওরা হাঁটছিল ইলিয়ট রোড ধরে ওয়েলেসলির দিকে। রাস্তাটা মহাত্মা গান্ধী রোড কিংবা আচার্য জগদীশচন্দ্র রোডের মতো চওড়া নয়। অপেক্ষাকৃত সরু। মাঝখানে ট্রাম লাইন। বাপ্পা দুপাশের বাড়িঘর দেখতে দেখতে যাচ্ছিল। কলকাতায় ও কম এসেছে। এদিকে কখনো আসেনি।
এখানকার বেশির ভাগ বাড়িই দেখছি পুরনো। আর একটু অন্য ধরনের।
রঞ্জু বলল, এ অঞ্চলটাই খুব পুরনো। আর এখানে বেশির ভাগই থাকত যাঁদের বলা হয় ফিরিঙ্গি। অর্থাৎ খাস ইউরোপীয়ান নয়। এই বাড়িগুলো সাহেবী কায়দার।
বাপ্পা চলতে চলতেই বলল, এখানে এলে মনেই হয় না কলকাতায় রয়েছি।
রঞ্জু হেসে বলল, কী মনে হয়?
মনে হয় যেন একশো বছর আগের পথ ধরে হাঁটছি, যে পথের দুধারে শুধু সেইসব নিম্নমধ্যবিত্তদের বাস, যারা পুরো ইউরোপীয়, না ভারতীয়, যাদের সাহেবী স্টাইলে থাকার সাধ কিন্তু সাধ্য ছিল না। এর পর যখন কলকাতায় আসব তখন তোর সঙ্গে চৌরঙ্গীটা ভালো করে ঘুরবো।
হঠাৎ রঞ্জু বলে উঠল, দ্যাখ, দ্যা হ্যারিকাকু।
বাপ্পা দেখল ওদিকের ফুটপাথ দিয়ে হ্যারিকাকু ছড়ি হাতে ধীরে ধীরে হাঁটছেন। তিনিও ওয়েলেসলির দিকে চলেছেন।
দাঁড়া ডাকি। বলে ডাকবার আগেই বাপ্পা ওর হাত চেপে ধরল।