সিদ্ধি কতদূর লাভ করতে পেরেছি তা আমি জানি না। তবে এখানে এসে আমি কেমন ভীত হয়ে পড়েছি। কেবলই মনে হচ্ছে খুব শিগগিরই কি যেন ঘটবে–যা শুভ ফলপ্রসূ নয়। আর তা আমি চাইওনি কখনো। আমি যা চেয়েছিলাম, তা তো তোমরা জানোই অলৌকিক এক রহস্যের যবনিকা উত্তোলন। তার জন্যে আমি প্রায় সারাজীবন কিনা করেছি। শেষ পর্যন্ত আমাকে এখানেই রুগ্ন, ভগ্নস্বাস্থ্যে চলে আসতে হলো।
আমি চাই তোমরা যত শীঘ্র পারো এখানে একদিনের জন্যেও চলে এসো। আমি বড্ড একা…।
স্টেশনে নেমে পুরনো চার্চ কিংবা ফাদার শ্যামুয়েলের কোয়ার্টার বললেই টাঙ্গা তোমাদের এখানে পৌঁছে দেবে। আমি আবার বলছি–আমি ভীত। তোমাদের আসা একান্ত দরকার।
আশা করছি তোমরা ভালো আছ।
–তোমাদের হ্যারিকাকু
কাঁপা কাঁপা অক্ষরে লেখা চিঠিখানা। ওটা পড়ে বাপ্পা ঠিক বুঝতে পারল না। তার মতো মানুষ হঠাৎ কিসের জন্যে এত ভীত হয়ে পড়লেন? চিঠিটার একটা বৈশিষ্ট্য আছে। চিঠির মাথায় আর শেষে দু-জায়গায় দুটি ক্রুস চিহ্ন।
বাপ্পা এতে অবাক হয়নি। কেননা, কলকাতায় হ্যারিকাকুর বাড়িতেও এই ক্রুসচিহ্ন দেখেছিল। দেওয়ালে, টেবিলে, এমনকি মাথার কাছেও ক্রুস। তিনি যে খুব ধার্মিক প্রকৃতির, যিশুর ওপর তার যে পরম নির্ভরতা বাপ্পা ছেলেমানুষ হলেও তা বুঝতে পারত। আর তার এই ভক্তি যে মোটেই লোকদেখানো নয়, আন্তরিক, সেটা বলে দেবার অপেক্ষা রাখত না। আর সে কারণেই বাপ্পা, রঞ্জু তাঁকে ভক্তি করত।
তবে হ্যারিকাকুর ওপর বাপ্পাদের যে আকর্ষণ তা কিন্তু মোটেই তার ধর্মপ্রাণতার জন্যে নয়, অন্য কারণ ছিল।
তাহলে সব ব্যাপারটা খুলে বলা যাক।
হ্যারিকাকুর ভালো নাম হ্যারোল্ড ইভেন্স। থাকতেন কলকাতার ইলিয়ট রোডের একটা অপরিচ্ছন্ন গলিতে।
বাপ্পা মাঝে মাঝেই দেশের বাড়ি থেকে কলকাতায় তার বন্ধু রঞ্জুর বাড়ি বেড়াতে আসত। ওদের বেশ বড়োসড়ো একটা লাইব্রেরি আছে। সেখানে বিদেশী গোয়েন্দা কিংবা অলৌকিক কাহিনির নানা বই। এইসব বই পড়ার লোভেই বাপ্পা ছুটিছাটায় কিছুদিন কলকাতায় এসে থেকে যেত।
রঞ্জুই ওকে হ্যারিকাকুর কথা বলেছিল।
একদিন নিয়ে যাব। দেখবি কী অদ্ভুত মানুষ!
ভূত আর অদ্ভুত এই দুটি জিনিসের ওপর মানুষের চিরদিনের আগ্রহ। বাপ্পার মতো একজন স্পিরিটেড ছেলের অ্যাডভেঞ্চারে তো আকর্ষণ থাকবেই।
তারপর একদিন রঞ্জু বাপ্পাকে নিয়ে এল হ্যারিকাকুর ইলিয়ট রোডের বাড়িতে।
বাড়িটা কিন্তু ইলিয়ট রোডের ওপরে নয়, একটা সরু গলির মধ্যে। গলিটাও নোংরা। সেখানে কোনো ভদ্র অভিজাত মানুষ বাস করতে পারে না।
যে বাড়িটার সামনে এসে ওরা দাঁড়াল সেটা একটা তিনতলা বাড়ি। ইটগুলো যেন ছাল চামড়া ছাড়ানো কঙ্কালের মতো হাসছে।
রঞ্জু আর বাপ্পা ভেতরে ঢুকল। একতলার ঘরগুলো গুদামঘর। চুনের গন্ধ।
দোতলায় উঠে এল। এখানে কয়েক ঘর ভাড়াটে আছে। বাপ্পা এক নজর দেখে নিল। তিনতলায় উঠতে উঠতে বলল, ভাড়াটেরা সবাই বোধহয় পুরুষ মানুষ। অন্তত যাকে বলে গেরস্ত তা নয়।
রঞ্জু বলল, কি করে বুঝলি?
প্রথমত, ঘরগুলোয় লোকে বাস করে কিন্তু দরজার সামনে জঞ্জাল জমে রয়েছে। ঝট পড়ে না। মেয়েরা থাকলে এরকম হতো না। দ্বিতীয়ত, বারান্দার তারে প্যান্ট, শার্ট লুঙ্গি, পা-জামা শুকোচ্ছে, কিন্তু কোনো শাড়ি, ব্লাউজ বা ছোটোদের জামাপ্যান্ট নেই।
রঞ্জু কিছু বলল না।
সিঁড়ি অন্ধকার। কোথায় পা ফেলছে বাপ্পা নিজেও তা জানে না। শুধু অন্ধের মতো রঞ্জুর পিছু পিছু উঠছিল।
অবশেষে তিনতলায় এসে হ্যারিকাকুর ঘর।
পাশাপাশি দুটো দরজা। দুটি দরজাই ভেতর থেকে বন্ধ। রঞ্জু যে দরজাটির সামনে গিয়ে দাঁড়াল তার গায়ে মস্ত ক্রুস আঁকা।
রঞ্জু আস্তে আস্তে কড়া নাড়ল। সাড়া পাওয়া গেল না। আবার কড়া নাড়ল।
জায়গাটা কিরকম লাগছে? রঞ্জু হেসে জিজ্ঞেস করল।
কলকাতা শহরে এখনও এমন জায়গা তা হলে আছে? এ তো রীতিমতো ক্রিমিনালদের লুকিয়ে থাকার জায়গা!
এরকম জায়গা আরো আছে।
বাপ্পা কী বলতে যাচ্ছিল এমনি সময়ে দরজা খুলে গেল।
দরজার সামনে যিনি এসে দাঁড়ালেন, পরনে তার ছিটের পাজামা, গায়ে ঢিলে ফতুয়া। মাথার চুল পাকা, ছোটো করে কাটা। রঙ ফ্যাকাশে, চোখ কটা। হাড় বের করা শীর্ণ শরীর। দুগাল বসে হনু দুটোকে ওপর দিকে ঠেলে দিয়েছে। গলায় একটা রুপোর ক্রুস।
তিনি বাপ্পার দিকে তাকিয়ে রঞ্জুকে বললেন, কী খবর রবিনসন? ভেতরে এসো।
এ বয়েসেও বেশ গমগমে গলা। কিন্তু কেউ এলে যে মুখে একটু হাসি ফুটে ওঠে। বৃদ্ধ ভদ্রলোকের মুখে সে হাসির চিহ্নটুকু নেই। প্রথম দর্শনেই বাপ্পার মনে হয়েছিল ভদ্রলোক হাসতে জানেন না। আর–যে মানুষ হাসে না, তার চরিত্রও বড়ো জটিল।
ভেতরে ঢুকে রঞ্জু বললে, হ্যারিকাকু, এ আমার বন্ধু বাপ্পা। বর্ধমান জেলার একটা গ্রামে থাকে। কলকাতায় মাঝে মাঝে আমাদের বাড়ি বেড়াতে আসে। ভালো ডিটেকটিভের মতো অনেক কটা চোর-ডাকাত ধরে দিয়ে নাম করেছে।
হ্যারিকাকু চোখ বড়ো বড়ো করে বললেন, বটে! বটে! ইয়ং ডিটেকটিভ! কিন্তু ব্রাদার, আমার এখানে তো চোর-ডাকাতের কেস পাবে না। তবে দোতলায় কয়েকটা পকেটমার আর একতলায় দুটো চোরাকারবারি আছে নগণ্য–তাদের নিয়ে কি চলবে? বলে চোখ ট্যারা করে রঞ্জুর দিকে তাকালেন।