ঐ মাঠের পরে বিরাট রানীসায়র।
রানীসায়র নাম হয়েছিল কেন কে জানে! হয়তো কোনো রানীর নামে। রানী তো আর একালে কেউ হয় না। হয় তো অতীতের কোনো জমিদারগৃহিণীর নামে সরোবরের নাম হয়েছে রানীসায়র।
ঐ সরোবরেই নাকি ডুবে মরেছিল কোন্ এক ডাক্তার। তারপর অপূর্ব পাল। তারপর গোকুল হালুইকরের বৌ। ডুবে মরেছিল এটা হয়তো ঠিক। কিন্তু নিশির ডাক? তাও কি আজকের দিনে বিশ্বাস করতে হবে?
.
কদিন পর।
রাত তখন কত কে জানে–টিপটিপ করে বৃষ্টি পড়ছিল। সমস্ত রানীচক গ্রামটা ঘুমে অচেতন। হঠাৎ সত্যব্রতর ঘুম ভেঙে গেল। কেউ যেন তাকে ডাকছে–ডাক্তারবাবু–ডাক্তারবাবু
সত্যব্রত বুঝল রুগীর বাড়ি থেকে কল এসেছে। তাড়াতাড়ি উঠে জানলা দিয়ে মুখ বাড়ালো কে?
দেখল, রীতিমতো একজন ভদ্রলোক। পরনে ট্রাউজার, গায়ে হাওয়াই শার্ট। ছাতা মাথায়।
দেখে অবাক হলো। রানীচকের মতো গ্রামে এরকম কেতাদুরস্ত লোক তো দেখেনি কখনো।
–কি চাই?
–একটু যেতে হবে। একজন পেসেন্ট
সত্যব্রত বড়ো টর্চটা নিয়ে নিচে নেমে এল। লণ্ঠন জ্বলল। ডিসপেন্সারির দরজা খুলে ভদ্রলোককে ভেতরে ডাকলো–আসুন।
ভদ্রলোক ঢুকলেন। সত্যব্রত লণ্ঠনটা টেবিলের ওপর রেখে স্মোরে বসল।
বসুন।
–না, বসবার সময় নেই। এখনি আপনাকে একবার যেতে হবে।
–কোথায়?
–মদনহাটি।
মদনহাটি! সে আবার কোথায়?
–নদীর ওপারে।
সত্যব্রত চুপ করে রইল। একে বৃষ্টি পড়ছে। তার পর এত রাত্রে নদী। পেরিয়ে
-কী ভাবছেন ডাক্তারবাবু? আপনাকে যেতেই হবে। নইলে আমার শ্বশুরমশাই বচবেন না।–ভদ্রলোক মিনতি করে বললেন।
–কিন্তু
— নানা, কিন্তু টিন্তু নয়–আপনাকে যেতেই হবে। ব্যস। সঙ্গে সঙ্গে সত্যব্রতর মন গলে গেল। উঠতে যাচ্ছে এমনি সময়ে ঘরে ঢুকলেন একজন মহিলা। চব্বিশ-পঁচিশ বয়েস। রীতিমতো সুন্দরী। কালো শাড়ির সঙ্গে কালো ব্লাউজ, কাঁধ থেকে ঝুলছে ফোমের কালো ব্যাগ, হাতে কালো লেডিজ ছাতা! এই রাত্রেও কালো কাচের চশমা পরেছেন।
তার ফর্সা ধবধবে রঙে কালোর এই সমারোহ বড়ো সুন্দর মানিয়েছিল।
ভদ্রলোক পরিচয় করিয়ে দিলেন।–ইনি আমার স্ত্রী। এঁরই বাবা
সত্যব্রত একটু অবাক হলো। যার বাবা মুমূর্ষ সে বাবাকে ফেলে এত সেজেগুজে ডাক্তার ডাকতে আসতে পারে!
ভদ্রলোক বোধহয় সত্যব্রতর মনের কথা আঁচ করতে পেরেছিলেন। বললেন, আপনি পাছে না আসেন সেইজন্যে ও নিজেই ছুটে এল।
সত্যব্রত কি করবে ভাবছিল–মহিলাটি টেবিলের কাছে এসে হাত জোড় করে বললে, আপনাকে যেতেই হবে ডাক্তারবাবু। যত টাকা ফি চান–
–টাকার লোভ আমার নেই। ও কথা দয়া করে বলবেন না।
–ক্ষমা করবেন। কিন্তু আপনি না গেলে আমার বাবা–বলতে বলতে ভদ্রমহিলার গলার স্বর ভারী হয়ে উঠল।
–আগে কেসটা কি বলুন শুনি। তারপর যাওয়া দরকার কিনা ভেবে দেখব।
বলে পেনটা খুলে টেবিলে রাখতে গেল–পেনের ক্যাপটা পড়ে গেল মাটিতে।
সত্যব্রত হেঁট হয়ে অন্ধকারেই ক্যাপটা খুঁজতে লাগল–পেল না। তখন সে টর্চটা নিয়ে আবার খুঁজতে লাগল। হঠাৎ টর্চের আলো গিয়ে পড়ল মহিলাটির পায়ে–আর সঙ্গে সঙ্গে সত্যব্রত একেবারে আঁৎকে উঠল। দেখল মহিলাটির পা থেকে গোড়ালি বেয়ে লম্বা লম্বা লোম গোল গোল হয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়েছে।
এইরকম লোম যে কোনো মানুষের হতে পারে কল্পনাও করা যায় না। সেই অমানুষিক লোম দেখে মুহূর্তের জন্যে বুঝি সত্যব্রতর মাথাটা ঝিমঝিম করে উঠেছিল। কিন্তু সে ঐ মুহূর্তের জন্যেই। তখন দুর্বল হয়ে পড়লে আর রক্ষা থাকবে না।
সত্যব্রত তখনি নিজেকে সামলে নিল। কলমের ঢাকাটা তুলে নিয়ে চেয়ারে সোজা হয়ে বসল।
কৃষ্ণবসনা সুন্দরী তখন চশমার ভেতর দিয়ে তার দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে।
সত্যব্রতর সঙ্গে চোখাচোখি হতেই মহিলাটি অধৈর্য হয়ে বললে, দেরি করবেন না। চলুন। ভোর হয়ে যাবে।
–কিন্তু কিসে যাব?–সত্যব্রতর মাথায় তখন বুদ্ধির প্যাঁচ খেলছে।
–আমাদের সঙ্গে একটু কষ্ট করে হেঁটেই যেতে হবে।
–হাঁটতে তো পারব না। পায়ে ব্যথা।
–কিন্তু হেঁটে না গেলে উপায় কি? এই পাড়াগাঁয়ে–
এক কাজ করুন। পাশেই গোয়ালপাড়া। ওখানে গিয়ে আমার কথা বলুন। ওরা গাড়ি দেবে।
অগত্যা ওদের গোরুর গাড়ির সন্ধানে যেতে হলো।
যেইমাত্র তারা দরজার বাইরে বেরিয়েছে অমনি সত্যব্রত ছুটে গিয়ে দরজা বন্ধ করে খিল এঁটে দিল। তারপর সোজা দোতলায়। দোতলার দরজাগুলোতেও খিল দিতে ভুলল না।
মুহূর্তের পর মুহূর্ত। মিনিটের পর মিনিট। তার পরই শুরু হলো নিচের দরজায় দুমদাম করে শব্দ। দরজা বুঝি ভেঙে পড়ে। সত্যব্রত দুহাতে কান চেপে বসে রইল যতক্ষণ না তোর হয়।
ভোর হবার সঙ্গে সঙ্গে শব্দ থেমে গেল।
লোহিত সাগরের আতঙ্ক
০১.
হ্যারিকাকু ও তাঁর ঘর
চিঠিখানা পেয়ে বাপ্পা বেশ একটু অবাক হয়ে গেল। যদিও সে ভাবছিল খুব শিগগির একদিন কলকাতায় গিয়ে হ্যারিকাকুর সঙ্গে দেখা করে আসবে, তা বলে কল্পনাও করতে পারেনি হ্যারিকাকু মনে করে তাকে চিঠি দেবেন।
তার আরও যেটা আশ্চর্য ঠেকল তা হচ্ছে চিঠিটা আসছে কলকাতা থেকে নয়, সুদূর সাঁওতাল পরগনার জগদীশপুর থেকে।
চিঠিখানা ইংরিজিতে লেখা। তার বাংলা তর্জমা এইরকম—
মাই ডিয়ার ইয়ং ফ্রেন্ডস্
আশ্চর্য হয়ো না এই খবর জেনে যে আমি আর কলকাতাতে নেই। বহুকালের বাস ছেড়ে চিরদিনের মতো এখানে চলে এসেছি। এখানে আসার জন্য আমার বন্ধু এখানকার পাদ্রী ফাদার শ্যামুয়েল অনেক দিন থেকে বলছিলেন। এখানে এসে থাকলেই আমি নাকি আমার গবেষণা, ভ্রষ্ট আত্মার অনুসন্ধান প্রভৃতি যা আমার জীবনের একমাত্র লক্ষ্য এবং যা আমার অত্যন্ত স্নেহভাজন, তোমরা দুজন জানতে তার সিদ্ধি ঘটবে।…