বাড়িটা পুরনো। দোতলা বাড়ি অবশ্য। ওপরে দুখানা ঘর। নিচে দুখানা। সে আমলের খড়খড়ি দেওয়া জানলা। ছাদের নিচে বড়ো বড়ো মোটা কড়ি। দেওয়ালে নোনা ধরেছে। হয়তো বা বর্ষায় ঘরের মধ্যে জলও পড়ে একটু আধটু। আলসের কোণ ছুঁড়ে একটা অশখগাছের চারা দিব্যি মাথা তুলেছে।
এ রকম পুরনো নির্জন বাড়িতে সত্যব্রতর থাকা অভ্যেস নয়। তার ভারি মজা লাগল। ভাবল মন্দ কি! নতুনত্ব আছে। মানুষকে তো সবরকম অভ্যেসের মধ্যে দিয়ে চলতে হয়। নানা অভিজ্ঞতার মধ্যে দিয়েই মানুষ বড়ো হয়। এও একটা অভিজ্ঞতা।
সত্যব্রত দেখল, ডিসপেন্সারিতে ওষুধপত্তর নেই বললেই হয়। যাও বা আছে সব পুরনো। এখন কত নতুন নতুন ওষুধ বেরিয়েছে, তার কিছুই নেই।
সত্যব্রত একটা লিস্ট করে নিজেই টাকা দিয়ে সেসব ওষুধ আনিয়ে নিল।
দেখতে দেখতে সত্যব্রতর হাতযশ ছড়িয়ে পড়ল। শুধু রানীচকই নয়–পাশাপাশি গ্রাম থেকেও রুগী আসতে লাগল। তারা সাধ্যমতো যা দেয় সত্যব্রত খুশি হয়ে তাই নেয়। সবাই বললে, এমন ডাক্তার হয় না।
শহর-বাজারেই রাত-বিরেতে ডাক্তার ডাকলে আসতে চায় না। গ্রামে তো কথাই নেই। রুগী মরে যাচ্ছে শুনলেও ডাক্তারবাবুরা আসবেন না। তাদের অনেক অজুহাত। গরমে বলবেন–সাপ, বর্ষায় বলবেন–জলকাদা, শীতে বলবেন–ঠাণ্ডা। আবার কেউ কেউ অন্য ভয়ও পান। সে কথা থাক।
সত্যব্রত এসবই জানত। রুগীদের বললে, গুরুতর কেস হলে তোমরা আমার কাছে এসো। যত রাতই হোক আমি যাব। গ্রাম-বৃদ্ধরা দুহাত তুলে সত্যব্রতকে আশীর্বাদ করলেন।
তার পর থেকেই সত্যব্রতর রাতের ঘুম ছুটে গেল। কেবল রুগীর বাড়ি থেকে ডাক আসে। কখনো দূর দূর গ্রাম থেকেও।
সন্ধ্যের সময় গ্রামের দু-চারজন প্রৌঢ় সত্যব্রতর ডিসপেন্সারিতে এসে বসেন। বয়েসে সত্যব্রত তাদের চেয়ে অনেক ছোটো। হলেও ডাক্তার তো। তাঁরা গল্পগুজব করেন। জ্বরজ্বালা হলে বিনা পয়সায় ওষুধও নেন।
তাঁদের মধ্যে একজন একদিন কথায় কথায় বললেন, বাবাজি, তুমি যে রাত-বিরেতে ডাক এলেই হুট করে ছোটো এতে তোমার উঁচু মনের পরিচয় পাওয়া যায়। তবে কিনা নিজের জীবনটা বাঁচিয়ে।
সত্যব্রত ভাবল, উনি বুঝি তার বেশি পরিশ্রমের কথা বলছেন। তাই হেসে বললে, এ বয়েসটা তো পরিশ্রম করারই বয়েস চরণকাকু।
-না না, পরিশ্রমের কথা নয় বাবাজি। আমি বলছি অন্য কথা।
তারপর একটু থেমে বললেন, তুমি আজকালকার ছেলে কলকাতার ছেলে–ওসব মানবে কিনা জানি না, তবে মনে রেখো পাড়াগাঁয়ে এখনো নানারকমের অলৌকিক ভয় আছে।
সত্যব্রত উৎসাহে নড়েচড়ে বসল। হেসে বলল, অলৌকিক ভয়! সেটা কিরকম?
–হাসছ বাবাজি? হাসির কথা নয়। এই তো সেবার-তোমারই মতো একজন নতুন ডাক্তার এলেন। তার পর একমাসও কাটল না হঠাৎ একদিন সকালে দেখা গেল ঐ রানীসায়রে তার দেহ ভাসছে।
–আত্মহত্যা করেছিলেন?
–না। রাত্রে নিশি ডেকে নিয়ে জলে ডুবিয়ে মারল।
একটু থেমে বললেন, পালেদের বড়ো নাতি অপূর্ব কলকাতার কলেজে পড়ত। ছুটিতে এল গ্রামে আম খেতে। গরমের জন্যে ছাদে শুত। একদিন সে দেখল–একটি ছেলে তাকে ডাকছে। ভারি সুন্দর দেখতে ছেলেটিকে। অপূর্বর কৌতূহল হলো। সে উঠে গেল। দিব্যি ছেলেটির পিছু পিছু সিঁড়ি দিয়ে নামল, খিল খুলল, তারপর রাস্তায় বেরিয়ে পড়ল। ছেলেটি চলেছে আগে আগেযাচ্ছে রানীসায়রের দিকে। তারপর–ব্যস!
শুনে সত্যব্রত জোরে হেসে উঠল।
চরণকাকু বিরক্ত হয়ে বললেন, এটা হাসির কথা নয়।
–তা ছাড়া কি! একেবারে গাঁজা।
–গাঁজা! আমি মিথ্যে কথা বলছি? শুধোও তো চাটুজ্যেমশাইকে। কী চাটুজ্যেমশাই?
চাটুজ্যেমশাই মাথা দোলালেন–ঠিক।
–মিত্তিরমশাই?
মিত্তিরমশাই বললেন, অত কেন? গোকুল হালুইকরের বৌটা মরল কি করে? ঐ রানীসায়রে–
সত্যব্রত বলল, আপনারা রাগ করবেন না, অপূর্ব পালের যে ঘটনাটা বললেন তা অনেকখানিই অতিরঞ্জিত বাড়িয়ে বলা।
–কি রকম?
–অপূর্ব তো ছাদে একলা ঘুমোচ্ছিল। তাকে যে একটি সুদর্শন ছেলে ডাকল–অমনি অপূর্ব যে গটগট করে নেমে গেল রাস্তা দিয়ে ছেলেটির পিছুপিছু চলল এসব আপনারা জানলেন কি করে? আপনারাও সেই সুন্দর ছেলেটিকে দেখেছিলেন নাকি?
বৃদ্ধের দল চুপ করে গেল।
সত্যব্রত বললে, দেখুন, অলৌকিক ব্যাপার সম্বন্ধে সব দেশেরই অধিকাংশ মানুষের একটা প্রচণ্ড দুর্বলতা আছে। তারা মানতে চায় বলেই খুব ঘটা করে রঙ চড়িয়ে গল্প বলে।
চাটুজ্যেমশাই কী বলতে যাচ্ছিলেন এমনি সময়ে একটা হাত-ভাঙার রুগী এল। প্রসঙ্গ চাপা পড়ে গেল।
সত্যব্রত রুগী নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। বৃদ্ধরা আস্তে আস্তে যে যার বাড়ি চলে গেলেন।
.
সত্যব্রত দোতলাতে একাই থাকে। একটি অল্পবয়সী ছেলে তার রান্নাবান্না করে দেয়। তার পর সেও সন্ধ্যের পর বাড়ি চলে যায়। তখন সত্যব্রতর মনে হয় বড্ড একলা। একটু গল্প করারও লোক নেই। তখন ঘুম না আসা পর্যন্ত ডাক্তারি বই পড়ে।
এক-একদিন বিকেলে ছাদে পায়চারি করে। ছাদ থেকে গ্রামের অনেক দূর পর্যন্ত দেখা যায়। ঐ যে নিমগাছটা ওটা কত কালের কে জানে! ঐ যে বিরাট অশথ গাছটা আকাশের আধখানা জুড়ে একটা মস্ত ছাতার মতো দাঁড়িয়ে রয়েছে, রোজ রাতে বোধহয় এরই কোনো ডালে বসে কালপাচা বিশ্রী শব্দ করে ডাকে। ওর পাশ দিয়ে রাস্তা চলে গেছে। দুপাশে বাঁশঝাড়। তারপর খাঁ-খাঁ মাঠ। এক-একদিন রাতে ঐ মাঠের ওপর দিয়ে দমকা বাতাস হা-হা করে ছুটে আসে। সেই শব্দে মানুষের ঘুম ভেঙে যায়। এখানকার লোকে ঐ হাওয়াকে বলে খারাপ হাওয়া। দুই আত্মা নাকি ছুটে বেড়াচ্ছে।