বললাম, হ্যাঁ, কিন্তু পারিনি।
বুড়িমা আবার ফিক করে হাসল। বললে, পেঁরেছ। পুঁরোপুরি সারিয়ে দিয়েছ।
আমি অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলাম।
হা গোঁ। ভাগ্যি তুমি ভঁয় না পেয়ে ঐ গভীর রাতে পিছু নিয়েছিলে। ভাগ্যি তুমি পড়ে গিয়েছিলে। তঁবেই না তেঁতটা অম্বুজার ভিতর ঘেঁকে বেরিয়ে এসে তোমায় তাড়া করে আঁসছিল। আঁর যেই আঁম্বুজাকে একবার ছেড়েছে, আঁর ওঁর ভিতর ঢুকতে পারবে না।
বলে বুড়িমা তার শণের নুড়ির মতো মাথাটা দোলাতে লাগল।
ব্যাস! রাজকন্যে ভালো হয়ে গেল। আঁর প্ৰেতটাকে পাঠিয়ে দিলাম ওঁর স্থানে। বলে হলদেটে শুকনো আঙুল তুলে চরটা দেখিয়ে দিল।
অম্বুজা তা হলে এখন কোথায়?
যথাস্থানে।
যথাস্থানটা কোথায় তা জিজ্ঞেস করতে আর সাহস হলো না।
কিন্তু আঁর নয়। ওঁঠো। তোমায় রাজবাড়ির দিকে এগিয়ে দিই।
বুড়িমা ঘরের ঝপ বন্ধ করে আমায় নিয়ে বেরিয়ে এল।
রাজবাড়ির দিকে যেতে যেতে বুড়ি হঠাৎ অন্যদিকে পা বাড়াল।
এদিকে একটু এঁসো।
এটা সেই জায়গা যেখান থেকে প্রেতটা তাড়া করেছিল।
ঐ দ্যাখো। বলে বুড়ি দূরে মাটির দিকে আঙুল তুলে দেখাল।
দেখলাম মাটিতে উপুড় হয়ে পড়ে আছে রাজকন্যা অম্বুজা। ঠিক যেন একগাদা ফুলের মালা।
ও কি মরে গেছে?
বুড়ি বললে–না। ওঁ একেবারে ভালো হয়ে গেছে। ঘুমোচ্ছে। তুমি ওঁকে কোলে তুলে নিয়ে রাজবাড়িতে লো।
আমি স্বচ্ছন্দে অম্বুজাকে কোলে নিয়ে রাজবাড়ির দিকে হাঁটতে লাগলাম।
কিছুদূর গিয়ে বুড়িমা বলল, আঁর যেতে পারব না। রাজামশাই তো আঁমায় তাড়িয়ে দিয়েছেন।
আমি বুড়িমাকে প্রণাম করলাম। বললাম, আর একটা কথা। আপনি কে বলুন তো!
বুড়িমা হঠাৎ গলা চড়িয়ে উৎকট হাসি হেসে উঠল। বলল, আঁমি? তিনশো বছরেরও বেশি হলে আমি ঐ চঁরে বাস কঁরতাম। তারপর মানুষজন দেখব বলে রাজবাড়ির কাছে থাকতাম। লোকে বলে আমি উইনি। ছেলেরা টিল মরে। রাজা খেদিয়ে দিলে আঁমায়। উঁবু আঁমায় থাকতে হবে এখানে। নইলে পেঁতদের ঠ্যাকাবে কে?
বলে বুড়িমা হঠাৎ সোজা হয়ে দাঁড়াল। একটা ঝোড়ো বাতাসে তার পাকা চুলগুলো উড়তে লাগল। সেই ঝোড়ো হাওয়ার মধ্যে একরকম ভাসতে ভাসতে বুড়িমা চরের দিকে চলে গেল।
রাজবাড়িতে যখন ঘুমন্ত অম্বুজাকে কোলে নিয়ে পৌঁছলাম তখন ভোর হয়েছে।
আজ এই প্রথম আমি হাঁকডাক করে রাজবাড়িতে ঢুকলাম।
কোথায় নিশীথ! আর কত ঘুমোবে তোমরা! ওঠো, দ্যাখো কাকে নিয়ে এসেছি।
রাজবাড়ির ঘুম ভাঙল। দোতলার জানলাগুলো ফটাফট খুলে গেল। সবাই অবাক হয়ে দেখছে এত ভোরে কে হাঁকডাক করছে।
রাজামশাই যে রাজামশাই যাঁকে বড়ো একটা দেখাই যেত না তিনিও নেমে এসেছেন। চোখ রগড়াতে রগড়াতে নিশীথও এসে হাজির।
কী ব্যাপার! রাজকন্যাকে কোথায় পেলে?
আমি সব ঘটনা ওঁদের বললাম। শুনে ওঁরা অবাক।
রাজকুমারী অম্বুজার তখন ঘুম ভেঙেছে। একজন অপরিচিত লোকের কোলে রয়েছে দেখে সে ফ্যালফ্যাল করে আমার দিকে তাকিয়ে রইল। আমায় চিনতে পারল না।
রাজকন্যাকে দেখিয়ে রাজামশাইকে বললাম, এই নিন মহারাজ আপনার কন্যাকে। আর ভয় নেই। ও এখন সম্পূর্ণ সুস্থ।
অম্বুজা রাজামশাইকে চিনতে পারল। বহুকাল পর বাবা বলে রাজামশাইয়ের বুকে ঝাঁপিয়ে পড়ল।
রাজামশাই আমার দিকে তাকিয়ে আনন্দে কৃতজ্ঞতায় ঝরঝর করে কাঁদতে লাগলেন।
আমি বিদায় নিয়ে কলকাতায় ফিরে এলাম।
[শারদীয়া ১৪০৭]
রহস্যময়ী
সে দিন বাসে একটি মেয়েকে দেখলাম। সুন্দরী মেয়ে। মুখ-চোখ নিখুঁত। রঙ ফর্সা। কিন্তু
লক্ষ্য পড়ল ওর বাঁ হাতের কব্জির ওপর। অনেকখানি জায়গা জুড়ে কালো জরুল। আর সেই জরুল থেকে কয়েকটা কালো কালো লম্বা লোম বাতাসে শুয়োপোকার মতো নড়ছে।
দেখে চমকে উঠলাম।
মেয়েটির জন্যে দুঃখ তো হচ্ছিলই–আহা, অত সুন্দরী মেয়ে–তারও কী সাংঘাতিক খুঁত। তবু যে চমকে উঠেছিলাম তার কারণ আছে।
সেদিন ঐ মেয়েটিকে দেখে হঠাৎ মনে পড়ে গেল কয়েক বছর আগের একটি ঘটনা। ঘটনাটা শুনেছিলাম সত্যব্রতর মুখেই। শোনার পর বেশ কয়েক রাত ঘুমোতে পারিনি। কেবলই মনে হয়েছিল–এ কি সম্ভব?
সেই ঘটনার কথা বলি।
.
সত্যব্রত তখন সবে ডাক্তারি পাস করেছে। বড়লোকের ছেলে। টাকার অভাব নেই। ছোটোবেলা থেকে তার ইচ্ছে ছিল–ডাক্তার হবে। আর ডাক্তার হয়ে কলকাতায় বসবে না। বসবে কোনো পল্লীগ্রামে। কলকাতায় তো বড়ো ডাক্তারের অভাব নেই। কিন্তু পল্লীগ্রামে বড়ো ডাক্তার নেই। বড়ো ডাক্তাররা সহজে শহর-বাজার ছেড়ে গ্রামে যেতে চায় না। কেননা গ্রামে নাকি পসার জমে না। রুগীর অভাব হয় তো হয় না কিন্তু টাকা? গ্রামের সাধারণ লোক ভারি গরিব। তারা ডাক্তারকে বেশি পয়সা দিতে পারে না।
আজকাল মানুষের মনটাই বদলে গেছে। টাকা ছাড়া মানুষ আর কিছু ভাবতে পারে না। যেখানে যত বেশি টাকা সেখানেই পাগলের মতো ছোটে।
কিন্তু সত্যব্রতর মনটা ছিল অন্যরকম। সে ভাবত টাকা নেই বলেই তারা বড়ো ডাক্তার দেখাতে পারবে না? এরকম হওয়া উচিত নয়।
তাই সত্যব্রত একদিন মা-বাবাকে প্রণাম করে একটা বেডিং, আর একটা সুটকেস নিয়ে রানীচকে চলে এল।
এখানে তার বাবার ছোটোবেলার এক বন্ধু থাকতেন। তিনিই উৎসাহ করে সত্যব্রতকে গ্রামে এনে বসাতে চেয়েছিলেন।
সেখানে একটা ছোটোখাটো ডিসপেন্সারি ছিল। তিনি বললেন, বাবা সত্য, এসবই তোমায় দিলাম। তুমি শুধু এখানে থাকো। গ্রামের লোকদের বাঁচাও।