সুভদ্রার হাত থেকে পিদিমটা পড়ে নিভে গেল।
সেই মুহূর্তে ঘরের মধ্যে মৃত্যুর দূত কাকরূপী প্রেত আর মাত্র পাঁচ হাত তফাতে দাঁড়িয়ে সে। কাকটা গোল গোল লাল চোখ ঘুরিয়ে তাকে দেখছে আর তার বড়ো বড়ো ঠোঁট দুটো ফাঁক করছে।
সুভদ্রা বুঝতে পারল এই ভয়টাই সে করছিল। একদিন তার বাবাকে মারবার জন্যেই কাকটা এসেছিল। কিন্তু মারতে পারেনি। এবার তার পালা।
কাকটা বসে বসেই তার ডানা দুটো তিনবার নাড়ল। খাট থেকে নামল। বড়ো বড়ো নখওলা দুটো পায়ে ভর করে এগিয়ে আসতে লাগল।
আর রক্ষে নেই। সুভদ্রা চিৎকার করে উঠল। কিন্তু এত বড়ো রাজপ্রাসাদের ছাদ, দেওয়াল, সিঁড়ি ডিঙিয়ে সে চিৎকার তার বাবার কানে পৌঁছল না।
নিজেকে লুকোতে সুভদ্রা অন্ধকার ঘরের এক কোণে গিয়ে গুঁড়ি মেরে বসে পড়ল। কিন্তু কাকটার জ্বলন্ত দৃষ্টি এড়াতে পারল না। কাকটা সেই দিকেই এগিয়ে আসতে লাগল। সুভদ্রা সরে আর একটা কোণে গিয়ে দাঁড়াল। তার গায়ে লেগে কি একটা ঠক করে মাটিতে পড়ল। ছিন্নমস্তার সেই খাঁড়াটা। কাকটা তখন তার ওপর ঝাঁপ দিয়েছে। মুহূর্তে সুভদ্রা খাড়াটা দুহাতে তুলে নিয়ে জোরে এক কোপ বাসিয়ে দিল। অন্ধকারে কোপটা কাকটার মাথায় লাগল না। লাগল একটা ডানায়। ডানাটা কেটে মাটিতে পড়ে লাফাতে লাগল। আর কাকটা এই প্রথম বিকট একটা শব্দ করে একটা ডানায় ভরে দিয়ে এঁকেবেঁকে বেরিয়ে গেল। সুভদ্রা মনের সমস্ত শক্তি একত্র করে খাঁড়াটা হাতে নিয়ে তার পিছু পিছু ছুটল। ওটাকে মারতেই হবে।
কিন্তু কাকটাকে আর দেখতে পেল না। এদিক-ওদিক তাকাল। হঠাৎ
ওটা কি?
দেখল রাজবাড়ির বাগানে একটা আমগাছের ডালে ঝুলছে একটা কঙ্কাল। তার একটা হাত কাটা।
বুড়ি এই পর্যন্ত বলে তার বক্তব্য শেষ করল।
আমি জিজ্ঞেস করলাম, সুভদ্রার কি হলো?
বুড়ি একটু থেমে মনে করবার চেষ্টা করে যা বলল তা এই–পরের দিন থেকে বেচারি মেয়েটা পাগল হয়ে গেল। এদিকে যাগ-যজ্ঞও শেষ। চরে আর ভূতের উপদ্রব নেই। আর কোনো মানুষ রাতে নিশির ডাক শুনে চরের দিকে গিয়ে প্রাণ হারায় না। কিন্তু
বুড়ি আবার একটু থেমেছিল। তারপর বলেছিল, কিন্তু সুভদ্রা পাগল হয়ে আর রাজবাড়িতে থাকত না। ঘুরতে ঘুরতে একদিন সে কোথায় হারিয়ে গেল। আর তাকে পাওয়া গেল না।
হারিয়ে গেল!
আমি সেই তিনশো বছর আগের এক না দেখা রাজকন্যার জন্যে দুঃখ পেলাম।
আমরা দুজনেই চুপ করে আছি। বুড়ির ঘরের কোণে পিদিমটা তখনও জ্বলছে। বললাম, সেই সুভদ্রার সঙ্গে আজকের এই অম্বুজার কি কোনো সম্পর্ক আছে?
বুড়ি তার তিনখানা মাত্র দাঁত নাড়িয়ে একটু হাসল। বললে, কি মনে হয়?
বললাম, মনে হয় যেন আছে।
তঁবে আবার জিজ্ঞেস করছ কেন? এক জন্মের সুভদ্রা আঁর এক জঁন্মেতে অঁম্বুজা। সব নিয়তির খেলা।
এবার বুড়ি আরও একটু পরিষ্কার করে যা জানালো তা এইরকম–
চন্দ্রভানু নিজেকে চাঁদ রায়ের বংশধর বলে মিথ্যে পরিচয় দিয়ে আসছিল বলেই এমন একটি মেয়েকে কুড়িয়ে পেয়েছিল যাকে নিয়ে তার অশান্তির শেষ ছিল না। তার মিথ্যে রাজপুরী মৃত্যুপুরী হয়ে উঠেছিল। মিথ্যে কথার এই শাস্তি। তবু যেহেতু তিনি বেশ কয়েকটা দেব মন্দির প্রতিষ্ঠা করেছিলেন তারই পুণ্যে তিনি কিছুটা শাপমুক্ত হয়েছিলেন পরে।
নিষ্পাপ মেয়ে অম্বুজার ওপর তার জন্মলগ্ন থেকেই ভর করে রইল চরের সেই কঙ্কালটা যে কাক হয়ে সুভদ্রার ক্ষতি করতে গিয়ে ছিন্নমস্তার খাঁড়ার আঘাতে একটা ডানা হারিয়েছিল। সেই রাগ পুষে রেখে এতকাল পর প্রতিশোধ নেবার সুযোগ পেল অম্বুজারূপী সুভদ্রার ওপর। সেই অপদেবতা তার ওপর ভর করে থাকার জন্যেই অম্বুজা অত নিষ্ঠুর হয়ে উঠেছিল। সেই অম্বুজারূপী সুভদ্রা কাককে এতই ভয় পেয়েছিল যে প্রতি রাতে নাচের মধ্যে দিয়ে ধূপের ধোঁয়ায় তাকে পুজো করত। কিন্তু কাকরূপী শয়তান সেই পুজোয় ভুলত না। অম্বুজাকে সেই ভয়ংকর চরের দিকে টেনে নিয়ে যেত।
নিরুপায় অম্বুজা তখন দেখাতে চেষ্টা করল সে নিজেই কাকের কত ভক্ত। তাই সে নানা জায়গা থেকে কাক যোগাড় করে রাজপুরী ভরিয়ে ফেলল। লোকে ভাবত অম্বুজার এটা একটা উৎকট শখ। কিন্তু অম্বুজার আসল উদ্দেশ্য জানত না।
পোষা কাকগুলো তার এতই বাধ্য হয়ে উঠেছিল যে অম্বুজা যেভাবে তাদের চালাত সেই ভাবেই তারা চলত। তাকে পাহারাও দিত। অম্বুজার এমনও গোপন ইচ্ছে ছিল যে সুবিধে পেলে তার এই পোষা কাকগুলোকে দিয়ে ঐ শয়তান কাকটাকে শেষ করে দেবে।
কিন্তু পারেনি। পারবে কি করে? শয়তান কাকটা তো সাধারণ কাক নয়।
এই পর্যন্ত বলে বুড়ি আবার থেমেছিল।
জিজ্ঞেস করেছিলাম, কিন্তু অম্বুজা তো পালিয়ে গিয়েও ফিরে আসত। শয়তান কাকটা কি চর পর্যন্ত টেনে নিয়ে যেতে পারত না?
বুড়ি হেসে বলল, কি করে পারবে? এইখানে এই বনের ধাঁরে আঁমি বসে আঁছি যে। আঁমাকে ডিঙিয়ে যাবে এমন সাধ্যি কোনো ভূত-প্রেতের নেই।
অবাক হয়ে গেলাম। বললাম, বুড়িমা, আর একটা কথা জিজ্ঞেস করব।
কঁরো। কঁরো। তাড়াতাড়ি করো। রাত ফুরিয়ে আসছে। আঁমি ঘুমুবো।
জিজ্ঞেস করলাম, আমায় যে তাড়া করে আসছিল সে কোথায়? অম্বুজার কি হলো?
বুড়িমা আবার হাসল। বলল, ওঁরা চঁলে গাছে যে যাঁর জায়গায়।
মানে?
বুড়িমা বলল, তুমি তো রাজকন্যাকে সরাতে এসেছিলে। তাই না?