একটা ছোটোখাটো ঝোপের মধ্যে দিয়ে ছুটছিলাম। গায়ে আর জোর নেই। হঠাৎ কিসে পা জড়িয়ে পড়ে গেলাম। তখনই ভয়ংকর ব্যাপারটা ঘটে গেল।
একটা কাক দলছুট হয়ে পিছিয়ে পড়েছিল। লক্ষ্য করিনি কখন সেটা আমার মাথার ওপরে ঘুরছিল। আমাকে পড়তে দেখে হঠাৎ তীক্ষ্ণ গলায় কা-কা-করে ডেকে উঠল।
আমি পালাবার জন্যে তাড়াতাড়ি উঠে দাঁড়ালাম। সেটাই হলো আমার মারাত্মক ভুল। অমনি অম্বুজা ছোটা বন্ধ করে থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল। আমায় দেখে ঘুরে দাঁড়াল। লক্ষ্য করলাম মুহূর্তমধ্যে অম্বুজার শরীরটা যেন বদলে যাচ্ছে। প্রথমে তার চোখ দুটো জুলতে লাগল। তারপর তার শরীর থেকে বেরিয়ে এল লম্বা একটা কী! কঙ্কালসার দুখানা হাত বের করে আমার দিকে সেটা এগিয়ে আসতে লাগল। ঐ হাড্ডিসার হাত দুটো ছাড়া তার সর্বাঙ্গ যেন কালো কাপড়ে মোড়া। মুখটাও দেখা যাচ্ছে না। শুধু দুটো জ্বলন্ত চোখ। সেই চোখ দুটো যেন বাতাসে ভাসতে ভাসতে আমার দিকে ছুটে আসছে।
আমি প্রাণপণে ছুটতে লাগলাম। কোনদিকে যাচ্ছি তাও জানি না। শুধু একটাই চেষ্টা যেন চরটার দিকে না যাই। কিন্তু কি আশ্চর্য কাকগুলো আর নেই। কঙ্কালটা অম্বুজার মধ্যে থেকে বেরিয়ে আসামাত্র সেই অলৌকিক কাকগুলো উধাও।
আমি ছুটছি–আর পিছনে একটা হু হু করে শব্দ। শব্দটা যে ঐ ভয়ংকর মূর্তিটার কাছ থেকেই আসছে তাতে সন্দেহমাত্র নেই–ধরে ফেলল বলে…মৃত্যু নিশ্চিত…
হঠাৎ দেখলাম সেই নিবিড় জঙ্গলের মধ্যে যেন একটা কুঁড়ে ঘরের মতো। আমি শুধু কে আছ বাঁচাও বলে আর্তনাদ করে আছড়ে পড়লাম। তারপর আর কিছু মনে নেই।
.
জ্ঞান যখন ফিরল তখন দেখলাম কতকগুলো শুকনো খড়ের ওপর আমি শুয়ে আছি। মাটির ঘর, মেঝেটাও মাটির। ঘরের মধ্যে একটা পিদিম জ্বলছে টিমটিম করে।
আমার কোনো চোট লাগেনি বলে বেশিক্ষণ অজ্ঞান হয়ে থাকিনি। এদিক-ওদিক তাকাতে দেখলাম একটু থুথুড়ে বুড়ি কতকগুলো শেকড়-বাকড় দরজার বাইরে ছুঁড়ে ছুঁড়ে দিচ্ছে আর ঘরের কোণে একটা ধুনুচি থেকে ক্রমাগত ধোঁওয়া উড়ছে। ঐ ধোঁওয়ায় আমার শরীরটা যেন তাজা হয়ে উঠল।
আমার জ্ঞান ফিরতে দেখে বুড়ি কাছে এল। পিদিমের আলোয় আমি তাকে চিনতে পারলাম। এখানে আসবার সময়ে একেই দেখেছিলাম। কতকগুলো ছেলে একে ইট মারছিল। পাল্কি থেকে নেমে আমি ছেলেগুলোকে তাড়িয়ে দিয়েছিলাম।
বুড়ি একবার বেরিয়ে গিয়ে একটু পরেই একটা মাটির ভাঁড়ে খানিকটা দুধ নিয়ে এল। একটা কথাও না বলে বুড়ি ভাড়টা আমার দিকে এগিয়ে দিল। আমি ভড়টা নিয়ে দুধটুকু খেয়ে ফেললাম। কেমন একটু বোটকা বোটকা গন্ধ লাগল। বোধহয় ছাগলের দুধ। কিন্তু বেশ গরম। দুধ কখন কি করে গরম করল কে জানে।
এবার বুড়ি আমার কাছে এসে বসল। বললাম, আমি কোথায়?
বুড়ি খোনা খোনা স্বরে বলল, আমার ঘরে।
যে আমাকে তাড়া করে আসছিল সে কোথায়?
বুড়ি তিনটে দাঁত বের করে বোধহয় একটু হাসল। বলল, ভঁয় নেই। ওঁরা চঁলে গেছে।
কোথায় গেছে?
যে যাঁর নিজের জায়গায়।
সেটা কোথায়?
এর উত্তরে বুড়ি ধীরে ধীরে সমস্ত কাহিনী আমায় জানাল।
.
অম্বুজা রহস্য
কলকাতায় ফিরে এসেছি। আবার চলছে আমার ডাক্তারি, মানে মানসিক রোগীদের চিকিৎসা। নিশীথ আমাকে যে কারণে বাগআঁচড়ার রাজবাড়িতে ডেকে নিয়ে গিয়েছিল তা সফল হয়েছে। নিশীথ নিয়ে গিয়েছিল রাজকন্যা অম্বুজার রোগ সারিয়ে দেবার জন্যে। কিন্তু তার যা ব্যাপার দেখলাম সেটা রোগ নয়, আরও ভয়ংকর কিছু। আমি তার কাছেই ঘেঁষতে পারিনি তো তার চিকিৎসা করব কী! তবে অম্বুজার রহস্য আমি ধরে দিতে পেরেছি। আর এই রহস্যর জাল খোলবার জন্য আমাকে যা-যা করতে হয়েছিল তা কলকাতায় ফিরে এসেও ভুলতে পারি না।
কলকাতায় আমার চেম্বারে বসে এক-এক সময়ে আমি যখন বাগআঁচড়ার সেই ভাঙাচোরা রাজবাড়িটার কথা ভাবি তখন মনে হয় সেসব যেন একটা দুঃস্বপ্ন ছিল। কোথায় গেল রাজা চন্দ্রভানু রায়–তার পরিবারের সেইসব মমির মতো বোবা মানুষগুলো, কোথায় গেল অম্বুজা আর সেই ভয়ংকর কাকগুলো?
সেদিন শেষ রাত্রে সেই থুখুড়ে বুড়ির দয়ায় আমি বেঁচে গিয়েছিলাম। কেন ও আমায় বাঁচাল? আমার মনে হয় ওকে সেইসব দুষ্টু ছেলেদের হাত থেকে বাঁচিয়েছিলাম বলেই। একথা তো চিরসত্য–সংসারে কিছু কিছু অকৃতজ্ঞ লোক থাকলেও তুমি যদি কোনো দিন কারোর উপকার কর তা হলে হয়তো তার কাছ থেকেও বিপদের সময়ে উপকার পেতে পার।
যাই হোক সেদিন রাতে বুড়ির দেওয়া গরম ছাগলের দুধ খাওয়ার পর যখন আমি বেশ সুস্থ হয়ে উঠেছিলাম তখন তার মুখে থেকেই অম্বুজার কাহিনী শুনেছিলাম। সে কাহিনী হয় তো আজ অবিশ্বাস্য বলে মনে হবে তবু তা বর্ণে বর্ণে সত্যি।
সেদিন ফোকলা দাঁতের ফাঁক দিয়ে খোনা খোনা গলায় ধীরে ধীরে কেটে কেটে অস্পষ্ট উচ্চারণে বৃদ্ধা যা বলেছিল আমি কলকাতায় ফিরে এসে একটা ডায়রিতে তা নিজের ভাষায় লিখে রেখেছিলাম। ঘটনাগুলো বৃদ্ধা বেশ গুছিয়ে বলতে পারেনি। তাই আমিও যা লিখে রেখেছি তার মধ্যে অনেক ফাঁক থেকে গেছে। আসলে তিনশো বছর আগের কাহিনী তো– কেউ প্রত্যক্ষদর্শী নেই। এ মুখ থেকে অন্য মুখ, এ কান থেকে অন্য কান এইভাবেই কিংবদন্তীর জন্ম হয়। ষাট বছর আগে আমার দেখা অম্বুজাও সেই কিংবদন্তীর একটি অস্পষ্ট নায়িকা হয়ে গেছে।