এই একটা বদ অভ্যাস ভদ্রলোকের। তার ছেলের মতো হলেও কিছুতেই আপনি ছাড়া কথা বলবেন না। আপত্তি করলে বলেন, আমি তো সেকালের মানুষ। আর কিছুতে না হোক অন্তত কাথায়-বার্তায় ছোটোদেরও সম্মান দেখাতে হয়। কাজেই তুমি, তোমার সঙ্গে যে আপনি আজ্ঞে করি সেটা ধরবেন না। ওটা আমার মুদ্রাদোষ।
আমি কথা ঘোরাবার জন্যে বললাম, আজ তো রবিবার। সকালে প্রেয়ার ছিল। চার্চে যাননি?
গিয়েছিলাম বৈকি। কাজ শেষ করেই বাড়ি ফিরে এসেছি। হ্যাঁ, বাদুড়ের ওপর বইটার কথা যেন ভুলে যাবেন না, ভাই। ওটা আমার খুব দরকার। আপনি যখন কলকাতায় যাবেন, কলেজ স্ট্রিটে বইটার খোঁজ করবেন। বাদুড় নামে হয়তো পাবেন না। প্রাণীজগৎ–এ ধরনের কোনো বই বাংলাতেই হোক কিংবা ইংরাজিতেই হোক দয়া করে একটু খোঁজ করবেন। বেশি দাম হলেও নেবেন। এই একশো টাকা রাখুন।
বললাম, টাকা এখুনি দিতে হবে না। আমার মনে থাকবে।
তখনই মনে হল পাদ্রীবাবাকে যখন হাতের কাছে পাওয়া গেছে তখন ইঁদুরের ব্যাপারটা জেনে নেওয়া যাক। অন্তত একজন ঠিক ব্যক্তির অভিমত জানা যাবে। মতলবটা মাথায় খেলতেই তাঁকে বিনীতভাবে বললাম–একটা কথা আপনার কাছ থেকে পরিষ্কার করে জেনে নিয়ে ইচ্ছে করছে। যদি বিরক্ত না হন–
উনি ব্যস্ত হয়ে বললেন, না না, বিরক্ত হব কেন? বলুন।
আমি তখন আমার বক্তব্যটা মনে মনে গুছিয়ে নিয়ে বলে গেলাম। শেষকালে যোগ করলাম, আপনি কি সত্যিই বিশ্বাস করেন বাদুড়, কালো বেড়াল-এর মতো ইঁদুরের মধ্যে দিয়েও ভৌতিক খেলা চলতে পারে?
উনি প্রথমে একটু হাসলেন। তারপর বললেন, যে কারণে বাদুড়ের ভূত হওয়া সম্ভব সেই একই কারণে ইঁদুরও ভূত হতে পারে। তবে কোন কোন বৈশিষ্ট্যে বাদুড়, কালো বেড়াল শয়তানের চর হয়ে ওঠে সেটা যেমন আমরা জানি না তেমনি ইঁদুর, ছুঁচো, চিল, শকুনের বৈশিষ্ট্যও জানা নেই।
আপনি বলতে চাচ্ছেন ইঁদুর ভূত ব্যাপারটা অসম্ভব কিছু না?
এই পৃথিবীতে রহস্যের শেষ নেই ভাই। মানুষ যতই বলুক আমি শেষ দেখবই, সেটা হবে তার মিথ্যে অহংকার। অনেক কিছুই সম্ভব।
একটু থেমে বললেন, কেন ইঁদুর নিয়ে কোনো সমস্যা হয়েছে নাকি?
ছোটো কোনো স্টেশনে অনেকক্ষণ ট্রেন দাঁড়িয়ে থাকার পর সিগন্যাল পাওয়া মাত্রই গাড়ি যেমন ছুটতে থাকে তেমনি পাদ্রীবাবার সম্মতি পাওয়া মাত্র আমার কথা শতধারায় ছুটতে লাগল। কোথাও যে একটু থামা দরকার তাও খেয়ালও রইল না।
কথা শেষ করে একটু জিরিয়ে নিয়ে বললাম, এই হল ব্যাপার। আজ করাত্রি ভয়ে ঘুমোতে পারি না।
বেশ কিছুক্ষণ পরে পায়ের চেটোয় হাত বোলাতে বোলাতে পাদ্রীবাবা বললেন, সব কিছুই তো ভয় থেকে উৎপন্ন। তাই
কিন্তু ভয়েরও একটা কারণ থেকে যাচ্ছে না? শুধু শুধু তো আর ভয় পাচ্ছি না।
পাদ্রীবাবা বললেন, তা হয়তো কিছুটা ঠিক, তা বলে মেঝেতে, দালানে মাটি দেখেই যদি ইঁদুর-ভূতের কাণ্ড ভেবে নেন তাহলে বেচারি ইঁদুরের ওপর অবিচার করা হবে।
তাহলে?
মাটিটা যেমন সত্য, ইঁদুর না থাকাটাও তেমনি সত্য। মনে হয় মাটির ব্যাপারে অন্য কারও হাত আছে।
বিস্ময়ের ধাক্কা সামলাতে না পেরে নড়েচড়ে বসলাম।
আবার কার হাত?
সেটাই লক্ষ রাখুন। আচ্ছা একটা অন্য কথা জিগ্যেস করি। আপনি কি আগে গানবাজনা করতেন?
যা বাবাঃ! কী কথা হচ্ছিল, কোন কথায় এসে পড়া গেল। সামলে নিয়ে বললাম, হা। করতাম। সে অনেক দিন আগে। সাবেক বাড়িতে থাকতে। তখন সবে ম্যাট্রিক দিয়েছিলাম। কিন্তু আপনি জানলেন কী করে? তখন তো আপনি আমাকে চিনতেন না।
পাদ্রীবাবা একটু হেসে আঙুল দিয়ে দেওয়ালের গায়ে সব থেকে উঁচু তাকটা দেখিয়ে দিলেন। পুরোনো বাড়ি ছেড়ে এ বাড়িতে এসেছি, এক সেট বায়া-তবলা একরকম পরিত্যক্ত অবস্থায় কাপড় জড়িয়ে একেবারে চোখের আড়ালে রেখে দিয়েছিলাম। পাদ্রীবাবারই চোখে পড়ল!
সলজ্জ হেসে বললাম, আপনি ঠিক লক্ষ করেছেন তো?
পাদ্রীবাবা হেসেই বললেন, কিন্তু আমার প্রশ্নের উত্তর পাইনি। অবশ্য প্রশ্ন আরও আছে। গানবাজনা যে করতেন তা তো দেখতেই পাচ্ছি। কিন্তু ছাড়লেন কেন? তাও ছেড়েছেন যেন আর কোনোদিন ওগুলো ছোঁবেনই না প্রতিজ্ঞা করে। তাই না? সে প্রতিজ্ঞা আজও রক্ষা করে চলেছেন। কী ব্যাপার আপত্তি না থাকলে বলুন।
আমি বোবা হয়ে গেলাম। সত্যি ক্ষমতা আছে পাদ্রীবাবার। আজ হঠাৎ এসেই এমন জায়গায় লক্ষ পড়ল যেখানে আর কেউ তাকায়ওনি। শুধু লক্ষ পড়াই না, উনি একেবারে শেকড় ধরে টানতে শুরু করেছেন। জীবনের যে চ্যাপ্টারটা একেবারে বন্ধ করে দিয়েছিলাম, সেই পরিত্যক্ত জীর্ণ পাতাগুলোই পাদ্রীবাবা নেড়েচেড়ে দেখতে চান। কিন্তু কেন? নিছকই কৌতূহল, না অন্য কোনো রহস্য আছে?
বললাম, কিছুমাত্র না। আসলে গানবাজনা ছেড়ে দেবার পেছনে
বুঝতে পারছি তীব্র অভিমান আছে।
না, অভিমান, রাগ, দুঃখ এসব কিছু নয়
তা হলে?
.
০৭.
পাদ্রী জগদীশ অ্যান্টনির কাছে সেদিন আমার গানবাজনা চর্চার ইতিকথা তুলে ধরেছিলাম।
আমাদের পরিবারে গানবাজনার চর্চাটা ছিলই। কেউ যে খুব নামকরা গায়ক বা বাজিয়ে হয়ে উঠতে পেরেছিলেন তা নয়। তবে বাড়িতে বসে নির্দোষ আনন্দ করার উপায় ছিল এই গানবাজনা।
আমি ভালো গাইতে না পারলেও মোটামুটি সুরজ্ঞান, লজ্ঞান ছিল। আমার যেমন গায়ক হবার কথা ছিল না, তেমনি বাজিয়ে হয়ে ওঠবার পেছনেও কোনো কারণ ছিল না। তবে কিনা পুরোনো আলমারির একেবারে নীচের তাকে এক জোড়া বাঁয়া-তবলা দেখে সেটা বাজতে ইচ্ছে করত। কিন্তু যেহেতু সেটা আমার ঠাকুর্দার শখের জিনিস ছিল, আর ওতে হাত দিতে সবাই বারণ করত তাই চোখের দেখা ছাড়া হাত দিতে সাহস হত না।