তিনি বেশ কয়েক বছর আমাদের বাড়ির কাছেই বাড়ি ভাড়া করে আছেন তবু কখন কোথায় যান তা লক্ষ করিনি। লক্ষ করার দরকার হয়নি। তাছাড়া, তখন আমার যৌবনকাল। খেলাধূলা, গানবাজনা নিয়ে ব্যস্ত থাকতাম। একজন বাপের বয়সী মানুষকে নজরদারি করার মানসিকতা আমার ছিল না। কাজের লোকের কথায় গুরুত্ব দিইনি। এখানে প্রথম এসে পর্যন্ত ঐ চার্চে তিনি থাকতেন। একাই থাকতেন। চারিদিকে জঙ্গল। কাছেই বহু কালের পুরোনো খ্রিস্টানদের কবরস্থান। খুব দরকার না হলে বিকেলেও কেউ ওদিকে যায় না। সন্ধের পর গা ছমছম করে তবু তিনি থাকতেন। নিশ্চয় তাঁর ভয করত না। তিনি বিশ্বাস করতেন তিনি একা নন। তাঁর সঙ্গে অদৃশ্য ভাবে রয়েছেন সদাপ্রভু যিশু। আর গলায় ঝুলছে রুপোর ক্রস। তা সেই বহুদিনের পরিচিত জায়গায় তিনি যখন খুশি, যতবার খুশি যেতেই পারেন। কার কী?
এইরকম সময়ে একদিন একটা ঘটনা স্বচক্ষে দেখে পাদ্রীবাবার ওপর একটা বিশেষ ধারণা তৈরি হয়ে গেল।
সেদিন বিকেলে আমার এক পুরোনো বন্ধুর সঙ্গে বেড়াতে গিয়েছিলাম। যেখানে গিয়েছিলাম সেখান থেকে চার্চটা বেশি দূরে নয়। খোয়াওঠা ধুলোভরা মেন রোড থেকে যে পায়ে চলা পথটা ডানদিকে নেমে আমবাগানের মধ্যে দিয়ে বাঁশঝাড়ের পাশ দিয়ে একটা খোলা জায়গায় গিয়ে মিশেছে, সেখানেই চার্চটা তার জীর্ণ ভগ্নদশা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। তার একটু দক্ষিণে এগোলেই দেখা যাবে অনেকগুলো শ্বেত পাথরের ফলক মাটিতে পোঁতা। এগুলোই এখানকার খ্রিস্টানদের কবরে এক-এক জনের স্মৃতিফলক। হঠাৎ মনে হল পাদ্রীবাবা প্রায়ই তো এই সময়ে এখানে আসেন। দেখি না গিয়ে আজও এসেছেন কিনা।
বন্ধুকে নিয়ে গির্জার চত্বরে গিয়ে দাঁড়ালাম। সন্ধের অন্ধকার ধীরে ধীরে বাদুড়ের ডানার মতো নেমে আসছে। একটা ঢ্যাঙা দেবদারু গাছের মাথায় সিঁদুরের ছোঁয়ার মতো এক চিলতে রোদ লেগেছিল। পাশের চাপাবনের ওপর থেকে একঝাক পাখি যেন ভয় পেয়ে পাখা ঝাঁপটে উড়ে পালাল।
আমরা এদিক-ওদিক তাকিয়ে দেখলাম পাদ্রীবাবা নেই। কিন্তু গির্জার পাশেই তাঁর ছোটো ঘরটার জানলার এক পাট খোলা। বুঝলাম উনি এসেছেন। আশ্চর্য! এই সন্ধেবেলা কোথায় বেড়াতে গেলেন!
আমি চেঁচিয়ে ডাকলাম, মিস্টার অ্যান্টনি! আমার গলার স্বরে চকিত হয়ে একটা শেয়াল সামনে দিয়ে ছুটে পালাল। আবার ডাকলাম, মিস্টার অ্যান্টনি।
ও! আপনি! এই যে যাই। বলে কবরখানার পিছন থেকে পাদ্রীবাবা হাসতে হাসতে এসে দাঁড়ালেন। তার পরনের পাজামা আর গেঞ্জি ধুলোয় ভর্তি। আর হাতে একটা কোদাল।
হঠাৎ এই সন্ধেবেলা এখানে! জিগ্যেস করলেন পাদ্রীবাবা।
বললাম, এদিকে বেড়াতে এসেছিলাম। ভাবলাম যদি আপনি এসে থাকেন, একবার দেখা করে যাই।
ভালো করেছেন। তবে দেখা পেতেন না। আমি এতক্ষণ বেরিয়াল গ্রাউন্ডের ঝোপ জঙ্গল সাফ করছিলাম।
আপনি সাফ করছিলেন কেন? করার লোক নেই?
জানি না। থাকার তো কথা। কিন্তু কাউকেই তো দেখতে পাই না। তাই বাধ্য হয়ে আমাকেই কোদাল, গাঁইতি নিয়ে সাফ করতে হয়।
আপনি তো না করলেই পারেন। আপনি পাদ্রী। আপনার অনেক সম্মান।
পাদ্রীবাবা হেসে বললেন, শুধু সম্মানই নয়, অনেক দায়িত্ব, বাবা। এটা কার কাজ এ নিয়ে তর্ক করা আমার মানায় না। এ জায়গা অতি পবিত্র। সেই পবিত্রতা আমাকেই বজায় রাখতে হবে। কিন্তু আপনারা টর্চ এনেছেন তো, বাবা! বড্ড অন্ধকার। সাপ-খোপের ভয়ও আছে।
বললাম, না, টর্চ না আনলেও ঠিকই চলে যাব। আর সাপের ভয়? আপনি যদি এই অন্ধকারে এখানে-ওখানে চলাফেরা করতে পারেন তাহলে আমরাই বা পারব না কেন?
উনি কোনো উত্তর দিলেন না। এগিয়ে এসে আমাদের দুজনের মাথায় গলার বড়ো ক্রসটা ঠেকালেন।
আমার গা-টা কেমন শিরশির করে উঠল। একটা হিমস্রোত বয়ে গেল মেরুদণ্ড দিয়ে।
নিরাপদেই বাড়ি ফিরে এলাম। নতুন করে পাদ্রীবাবার কথা ভাবতে চেষ্টা করলাম। চার্চের এবং বেরিয়াল ফিল্ডের সংলগ্ন জায়গার পবিত্রতা রক্ষা করার দায়িত্ব কি শুধু তাঁর? তিনি যে এত নির্ভয় তা কি শুধু ঐ পবিত্র ক্রসের প্রভাবে? কিন্তু ঐ ক্রস কি বাঁচতে পারে বিষাক্ত সাপের ছোবল থেকে? পারে হয়তো। না, আমরা কল্পনা করতে পারি না।
শ্রদ্ধায় মাথা নত হয়ে গেল।
তবু–
তবু কাঁটা খস্থ করতেই লাগল।
এক নম্বর–তিনি কেন আমাদের অন্যদিন বেলাবেলি আসতে বললেন না একবারও?
দুনম্বর–সন্ধে হয়ে গেছে। তবু যে ঘরটায় তিনি বসেন সেটা অন্ধকার। তখনও আলো জ্বালা হয়নি। আলো জ্বালানো হবে তো? নাকি তিনি অন্ধকারেই চলাফেরা করবেন?
আশ্চর্য! অথচ যখন আমাদের পাড়ায় থাকেন তখন আলাদা মানুষ–একেবারে সাধারণ স্বাভাবিক জীবন।
যাই হোক, এ সব ভেবে লাভ নেই। পাদ্রী সাহেব আমার বাবার বন্ধু। পিতৃতুল্য। তাঁকে যেন চিরদিন শ্রদ্ধা করেই যেতে পারি।
.
০৬.
একেবারে ঘরোয়া পোশাকে এসে বসলেন পাদ্রীমশাই। পরনে ধুতি লুঙ্গির মতো করে পরা। গায়ে ফতুয়া।
মন দিয়ে কীসের তালিকা করছেন? নিমন্ত্রিতদের লিস্ট নাকি? দেখবেন আমি যেন বাদ না পড়ি।
হেসে বললাম, এটা যদি নিমন্ত্রিতদের তালিকা হত তাহলে অন্তত আপনি বাদ পড়তেন না। আপনার চেয়ে কাছের মানুষ আমার আর কেউ নেই।
উনি গম্ভীর ভাবে বললেন, আপনি তো এখনও ছেলেমানুষ, অভিজ্ঞতা নেই। তাই জানেন না কাছের মানুষরাই বাদ পড়ে যায়।