পরের দিন সকালে চা খেয়ে বাইরের ঘরে বসলাম মৃতের সেই অসমাপ্ত তালিকাটা নিয়ে।
এই ছোটো শহরেই অন্য একটা বাড়িতে আমার জন্ম। সেই বাড়ি থেকেই পড়াশোনা, খেলাধূলা। সেখানেই আসত আমাদের ক্লাসের বন্ধুরা। ক্যারাম খেলা হত। আর একটা খেলা ছিল গোলকধাম। কাজেই গত পাঁচ বছরে এখানকার কারা মারা গেছে তা খুঁজতে অসুবিধা হল না। ঝাড়াই-বাছাই করে দেখলাম ঐ সময়ের মধ্যে এখানকার নজন মারা গেছে। তার মধ্যে তিনজন আমার সমবয়সী, কিন্তু ঠিক বন্ধু নয়, পরিচিত। বাকি ছজন নানা বয়সের।
আজ পর্যন্ত আমি যা লক্ষ করে দেখেছি তাতে বুঝতে পেরেছি যে আত্মাটি আমাকে বার বার দেখা দিয়েছে (বরঞ্চ বলি হানা দিয়েছে) সে কোনো ধীরস্থির মানুষের আত্মা হতে পারে না। অনুমান–সে কোনো উঠতি বয়সের আত্মা।
এই ভাবে বাছাই করতে গিয়ে তালিকাটা বেশ ছোটো হয়ে গেল। খুশি হলাম। দেখলাম সন্দেহভাজনের এই তালিকায় তিনজনের নাম উঠে আসছে। তিনজনেই আমার জানাশোনা, উঠতি বয়সের। তিনজনেই ছিল একটু রাগী স্বভাবের। কাজেই এদের যে কেউ একজন হতে পারে। তিনজনের মধ্যে একজনই মরেছে অপঘাতে। সাপে কামড়ে ছিল। সাপের কামড়ে মৃত্যুকে অপঘাত বলে কিনা ঠিক জানি না। অবশ্য অপঘাতে মৃত্যু হলেই যে ভূত হবে এর কোনো মানে নেই। স্বাভাবিক মৃত্যু হয়েছে এমন বহুজনের আত্মা প্রেত হয়ে ঘুরে বেড়িয়েছে বহুকাল। অতএব
আর একটা ক্লু পেয়েছি বলে মনে হচ্ছে। আমি তো কয়েকবার আত্মাটির আকার লক্ষ করেছি। দেখেছি তার হাইট প্রায় সাড়ে পাঁচ ফুট। এখন যে তিনজনকে আমি শেষ পর্যন্ত সন্দেহের তালিকায় রেখেছি তাদের মধ্যে কার হাইট সাড়ে পাঁচ ফুটের কাছাকাছি চোখ বুজে একটু ভাবলেই ধরতে পারব।
সেই রকম চেষ্টা করলাম। কিন্তু তিনজনের হাইট কীরকম গোলমাল হয়ে গেল। অর্থাৎ রামের হাইট শ্যামের গায়ে, শ্যামের হাইট যদুর কাঁধে। মুশকিলে পড়লাম। কী করব ভাবছি, দরজায় শব্দ। উঃ এখন আবার কে এল? যত বাধা
কে? বিরক্তিঝরা গলায় হাঁকলাম, ভেতরে আসুন।
যিনি ভেতরে ঢুকলেন তাকে দেখেই অবাক হলাম। খুশি তো হলামই।
আপনি! আসুন-আসুন। কী সৌভাগ্য! হাসিমুখে ঘরে ঢুকলেন জগদীশ অ্যান্টনি মশাই।
.
০৫.
আমাদের এখানে বর্তমানে খ্রিস্টান পরিবার অল্পই। কিন্তু ইতিহাস হচ্ছে এই–১৭৫৭ সালে পলাশীর যুদ্ধে বাঙালির শেষ স্বাধীন নবাব সিরাজদ্দৌলার শোচনীয় পরাজয়ের পর ইংরেজরা যখন এই বাংলাদেশের মাটিতেই ঘাঁটি গেড়ে বসল তখন থেকেই মোটামুটিভাবে বলা যায় এ দেশে খ্রিস্টানদের বসবাস শুরু। তারপর ১৮০০ সালে কলকাতায় ফোর্ট উইলিয়ম কলেজ স্থাপিত হল। এই কলেজ স্থাপনের উদ্দেশ্য ছিল, যেহেতু এ দেশেই সাহেবসুবোদের করে খেতে হবে সেহেতু সর্বাগ্রে দরকার বাংলা শেখা। বাংলা না শিখলে বাঙালিদের সঙ্গে মিশবে কী করে? সেই কারণেই ফোর্ট উইলিয়ম কলেজ তৈরি।
একদিকে যেমন ইংরেজরা বাংলা শিখতে শুরু করল, অন্যদিকে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির অফিসে চাকরি পাওয়ার তাগিদে বাঙালিদেরও ইংরিজি শেখার তাড়াহুড়ো পড়ে গেল। সেই সঙ্গে শুরু হল এ দেশের মানুষের কাছে দয়াল প্রভু যিশু খ্রিস্টের মাহাত্ম্য বর্ণনা করে খ্রিস্টধর্ম প্রচারের কাজ।
এই উপলক্ষে দেশের সর্বত্র গির্জা তৈরি হল। নানা জায়গা থেকে আসতে লাগল সংসারত্যাগী পাদ্রীরা। এই পাদ্রীদের মধ্যে অধিকাংশদের জীবন ছিল সংযত, পবিত্র। তাঁদের স্বভাব ছিল ধীর, স্থির, শান্ত। তাঁরা যিশুর মতোই জাতি-ধর্ম-নির্বিশেষে ছোটোদের কাছে টেনে নিতেন। ফলে সাধারণ গেরস্ত পরিবারগুলি পাদ্রীদের খুব শ্রদ্ধা করত। পাদ্রীদের প্রভাবে এ দেশে বহু দরিদ্র, অল্পশিক্ষিত মানুষ খ্রিস্টধর্ম গ্রহণ করল। আশা ছিল, দুঃখ-দুর্দশায় ইংরেজরা তাদের দেখবে। হয়তো খুব বেশি সাহায্য পাওয়া যেত না তবে এই সব দরিদ্র অবহেলিত মানুষদের তারা অনেক কাছে টেনে নিয়েছিলেন।
আমাদের এখানে শহরের প্রায় বাইরে যে প্রাচীন গির্জাটি আছে সেটির প্রতিষ্ঠা করেছিল চার্চ অফ স্কটল্যান্ড মিশন ১৮২৫ খ্রিস্টাব্দে।
চার্চ তৈরি হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে স্থানীয় খ্রিস্টধর্মীরা নিয়মিত ধর্মচর্চার জন্যে নিজেদের মতো করে একটি পবিত্র আশ্রয় পেলেন। দূর দূর গ্রাম থেকেও খ্রিস্টভক্তরা প্রতি রবিবার এই চার্চে প্রেয়ারে যোগ দেবার জন্যে আসতে লাগলেন।
আমরা খ্রিস্টান ছিলাম না। তবু বাবার এই সব স্থানীয় খ্রিস্টান বন্ধুরা খুব সহজেই আমাদের বাড়ি আসতেন। আমরাও ভোলা মনে তাদের গ্রহণ করতাম। এখানেই প্রথম দেখি একজন লম্বা, কালো স্বাস্থ্যবান মানুষকে যাঁর সঙ্গে বাবা হ্যান্ডশেক করতেন। বাবার এক বন্ধু আলাপ করিয়ে দিয়েছিলেন। এঁর নাম ফাদার জগদীশ অ্যান্টনি। সম্প্রতি কৃষ্ণনগর থেকে এখানকার পাদ্রী হয়ে এসেছেন।
তাঁকে প্রথম দেখেই আমার ভালো লাগেনি। কারণ অন্যরা ধুতি-পাঞ্জাবি, শাল গায়ে দিয়েছিলেন, আর উনি সাদা ফুলপ্যান্টের ওপর পরেছিলেন কালো লম্বা একটা জোব্বা। তাঁর গলায় যে রুপোর ক্রসটা ঝুলত সেটাও ছিল পেল্লায় বড়ো, তা ছাড়া তাঁর চওড়া চোয়াল, চ্যাপ্টা মুখের ওপর ড্যাবডেবে দুটো চোখ আমার ভয়ের উদ্রেক করত।
জগদীশ অ্যান্টনি তখন থাকতেন, সেই চার্চের পাশে একটি ঘরে একা। সেখান থেকে বিকেলে হাঁটতে হাঁটতে আসতেন গঙ্গার ধারে। কখনও আমাদের বাড়ি বাবার কাছ। ছোটোবেলা থেকে তাকে দেখতে দেখতে অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছিলাম। আর ভয় পেতাম না। চেহারা অসুরের মতো হলেও মানুষটা সত্যিই ভালো।