নকুল বললে, এ কী কাণ্ড করলেন, দাদা? গোটা বাড়ি ভাঙবেন নাকি?
রেগে উঠে বললাম, দরকার হলে তাই ভাঙবসসর্পে চ গৃহে বাসো মৃত্যুরেব ন সংশয়ঃ। মানে বুঝলে?
নকুল অসঙ্কোচে স্বীকার করল মানে কিছুই বুঝতে পারেনি।
বললাম, এর মানে হল একই বাড়িতে সাপ নিয়ে বাস করলে মৃত্যু নিশ্চিত।
নকুল চোখ বড়ো বড়ো করে বলল, আবার সাপ এল কোথা থেকে, দাদা?
.
০৪.
বাস্তবিক জগদীশ অ্যান্টনির মুখের ঐ একটি কথাই আমার মাথা গোলমাল করে দিল। আমি নিশ্চিত জানি বাদুড় কীভাবে ভূত হতে পারে–পাদ্রীবাবা এই তর্ক তুলতে গিয়ে এক নিঃশ্বাসে চিল, শকুন, ইঁদুর, ছুঁচোর কথাও বলে ফেলেছিলেন। বিশেষ করে ইঁদুরের ওপর জোর দেবার কোনো কারণ ছিল না। অথচ দ্যাখো, ইঁদুরের কথাটা কানে আসা মাত্র ওটা খটাস করে ব্রেনে লক্ হয়ে গেল। কেমন বদ্ধমূল ধারণা হল বাড়িতে ইঁদুর তো ঢোকেনি, ঢুকেছে ইঁদুরের শরীর ধরে একটা অশুভ আত্মা।
আমি জানি এটা আর কিছুই নয়, ভৌতিক পরিবেশে বাড়িতে বসে থেকে থেকে মনের মধ্যে এক ধরনের দুর্বলতা তৈরি হয়ে গেছে। ছি ছি, শেষ পর্যন্ত ইঁদুরের ভয়ে গোটা বাড়ির মেঝে চটিয়ে ফেললাম! অথচ একটি ইঁদুরের লেজ পর্যন্ত কোনোদিন দেখা যায়নি। ঠিক করলাম এই দুর্বলতা আমাকে কাটিয়ে উঠতেই হবে। নইলে হয়তো পাগল হয়ে যাব।
আর আশ্চর্য যেদিন এই রকম প্রতিজ্ঞা করলাম সেই রাতেই ঘটল একটা ঘটনা। ঘটনাটা এইরকম–কেউ যেন আমার ঘরের দরজায় আস্তে আস্তে কড়া নাড়ছে–খটখটখট–
চমকে উঠে বসলাম। তখনও কেউ কড়া নেড়েই যাচ্ছে–খটাখটখটাখট খটাখট–
না, ভুল শোনা নয়। সত্যিই কেউ আমাকে ডাকছে। মশারির মধ্যে বসেই চাপা গলায় জিগ্যেস করলাম, কে?
উত্তর নেই। শুধু একটানা সেই শব্দ–খটাখট খটাখট খটাখট–
আশ্চর্য! এত রাত্রে কে ডাকছে? বাইরের কেউ নয়। বাইরের কেউ হলে বাড়ির মধ্যে ঢুকবে কী করে? নিশ্চয় এ বাড়িরই কেউ। সেই কেউ নকুল ছাড়া আর কেই বা হতে পারে? চেঁচালাম, এত রাত্রে কী ব্যাপার, নকুল?
উত্তর নেই।
এবার হাঁকলাম, নকুল!
সাড়া নেই। ধরার লোক না থাকলে টেলিফোনে যেমন রিং হয়েই যায় তেমনি কড়া নাড়া চলতেই লাগল। আমি প্রচণ্ড রাগে বিছানা থেকে নেমে দরজার কাছে এগিয়ে গেলাম।
কে-এ-এ?
তখন মনে হল কড়া নাড়ার শব্দটা যেন আর কাছে নেই। আস্তে আস্তে দূরে চলে যাচ্ছে।
অ্যাই নকুল–বলে খিল খুলতে গিয়ে দাঁড়িয়ে পড়লাম। আশ্চর্য, খিলটা এতটা উঠে এল কী করে? আমি তো ভালো করে এঁটেই বসিয়েছিলাম। কেউ কি তাহলে বাইরে থেকে খিল খোলবার চেষ্টা করছিল? কিন্তু তাই বা সম্ভব কী করে? না, এ রহস্য আর সহ্য করা যায় না। মনের সমস্ত শক্তি একত্র করে খিলটা খুলে ফেললাম।
আবার সেই গা-হিম করা অন্ধকার বারান্দা। আমি কীসের তীব্র আকর্ষণে এগিয়ে চললাম। সামনে কিছু যেন ভেসে যাচ্ছে…. কী ওটা? একটা সাদা চাদর … যেমন দেখেছিলাম সেদিন নকুলের ঘর থেকে জানলার ভেতর দিয়ে ভেসে যেতে।
হঠাৎ আমার পিছনে কার পায়ের শব্দ! তারপরই কেউ ঝাঁপিয়ে পড়ল আমার উপর। আমি পড়ে যাচ্ছিলাম–কে যেন আমাকে প্রাণপণে আঁকড়ে ধরে রইল। বেঁচে গেলাম।
পরের দিন অনেক বেলায় ঘুম ভাঙল। সারা দেহে ব্যথা। নকুল এক বাটি গরম দুধ খাওয়ালো। ও যা বলল সংক্ষেপে তা এই
অনেকক্ষণ ধরেই কড়া নাড়ার শব্দ শুনতে পাচ্ছিল। প্রথমটা ঘুমের ঘোরে বুঝতে পারেনি শব্দটা কোথায় হচ্ছে। পরে নাম ধরে ডাকতেই ধড়মড় করে ওঠে বারান্দায় এসে দাঁড়াল। দেখল আমি অন্ধকারেই টলতে টলতে চলেছি। আমার সামনে একটা সাদা চাদর বাতাসে ভাসতে ভাসতে যাচ্ছে। বুঝতে পারল আমার বিপদ। তাই আমার পিছনে গিয়ে দাঁড়াল। আমি চাদর লক্ষ করে নাকি শূন্যে লাফ দিয়েছিলাম। আর তখনই নকুল আমাকে আঁকড়ে ধরে ফেলেছিল।
তিন দিন বাড়ি থেকে বেরোতে পারিনি। কিছু চিন্তা করতে গেলেই মাথায় যন্ত্রণা। তাই শুয়ে ঘুমিয়ে, অর্ধজাগরণে বাড়িতে পড়ে রইলাম। ভাগ্যি নকুল ছিল। নিজের ভাই-এর মতো ও সর্বক্ষণ আমার বিছানার পাশে। আবার নকুলকে দেখে অবাক হয়েছি। ওর মুখটা এত চেনা চেনা লাগছে কেন?
এক সপ্তাহ পর যখন উঠে বসতে পারলাম তখন প্রথম যে কথাটা মনে হল তা হচ্ছে এটা কী হল? এতদিন যা হয় একরকম হচ্ছিল। যখন-তখন যেখানে-সেখানে ছায়া দেখা। সে আমার কোনো ক্ষতি করার চেষ্টা মাত্রও করেনি। শুধু দেখা দিচ্ছিল। যেন ও যে কে তা জানাতে চাইছিল। এতে শুধু কৌতূহলটাই বেড়েছিল। আর কিছু নয়। তারপর হঠাৎ নকুলকে আক্রমণ। কেন?
তারপর গভীর রাতে আমার বেডরুমে হানা। লুকিয়ে-চুরিয়ে নয় রীতিমতো কড়া নেড়ে। তারপর যেই দরজা খুললাম অমনি পালাল। কীভাবে পালাল? ছায়াশরীরটুকু নিয়েও নয়। হালকা চাদরের মতো শূন্যে ভাসতে ভাসতে। নকুল বলছে, আমি নাকি শূন্যে ভাসমান সেই চাদরটা ধরতে গিয়েছিলাম। আশ্চর্য! এতখানি বোকামি আমি করেছিলাম। আর তার পরিণতিতে সাংঘাতিক দুর্ঘটনা ঘটে যেতে পারত।
সে না হয় যা হবার তা হত। কিন্তু প্রেতাত্মাটির আসল ইচ্ছাটি কী? সেটা জানা সহজ হত যদি জানতে পারতাম তিনি কে?
ঠিক করলাম কাল সকাল থেকেই আবার সেই মৃতের তালিকাটি নিয়ে বসব। গত পাঁচ বছরে যারা মারা গেছে তাদের লিস্টটা আগে ফাইনাল করব। অবশ্য সেই সঙ্গে একটা ছোটো তালিকা করব ওদের মধ্যে যাদের অস্বাভাবিক মৃত্যু ঘটেছে তাদের। কারণ, প্রচণ্ড ক্ষোভ না থাকলে কোনো আত্মা বারে বারে এক জায়গায় হানা দেয় না। শুধু এক জায়গাতেই নয় বিশেষ একজনকেই টার্গেট করে আছে।