যাক বাঁচলাম। কি ভাগ্যি সার্টিফিকেটগুলো হারাওনি।
—আমি সময়ে সময়ে হার মানি, কিন্তু চট করে কিছু হারাই না।
–থাক। হয়েছে। আজ পর্যন্ত কটা ছাতা, কটা টর্চ, কটা পেন হারিয়েছ তার হিসেব দেব? ওটা আবার কি? ব্যাগের মধ্যে!
–ঐ দ্যাখো, একদম ভুলে গেছি। অবশ্য এমন-কিছু নয়। একটা ছবি।
.
গত কাল হাসপাতাল থেকেই সঞ্জয় গিয়েছিল এক বৃদ্ধ রুগীকে দেখতে। বৃদ্ধ সঞ্জয়ের চিকিৎসায় ক্রমশ উন্নতি করছে।
রুগী দেখা হয়ে গেলে তার বাড়ির লোক অনুরোধ করল এক কাপ কফি খাবার জন্যে। সঞ্জয় খুব টায়ার্ড ছিল। খেতে রাজী হল।
বাইরের ঘরে বসে বৃদ্ধের ছেলের সঙ্গে সঞ্জয় গল্প করছিল। কথা বলার ফাঁকে ফাঁকে সে বাড়িটা দেখছিল। পুরনো বাড়ি। সামনে অনেকখানি উঠোন। ওদিকে ভাঙা পুজোদালান। বাড়ির একদিকটা ভেঙে পড়েছে।
সঞ্জয় জিজ্ঞেস করল, গোটা বাড়িটাই আপনাদের?
ভদ্রলোক একটু হেসে বললেন, হ্যাঁ।
–পুজোটুজো হতো দেখছি।
–হ্যাঁ, সে-সব বহুকাল আগে। দুর্গাপুজো, কালীপুজো দুইই হতো। শুনেছি একবার বলি বেধে যাওয়ার পর থেকে পুজো বন্ধ হয়ে যায়।
বাড়িটা কবে তৈরি হয়েছিল?
ভদ্রলোক বললেন, তা বলতে পারি না। ঠাকুর্দা কিনেছিলেন জলের দরে, সেই বম্বিং-এর সময়ে।
সঞ্জয় কফিতে চুমুক দিয়ে বলল, আচ্ছা, আগে তখন এই-সব জায়গা কিরকম ছিল? :
ভদ্রলোক হাঙ্গলেন। বললেন, আমি ঠিক বলতে পারব না।
সঞ্জয় একটু লজ্জিত হল। বলল, তা ঠিক। আপনি আর কি করে বলবেন? আসল কথা কি জানেন, এইরকম পুরনো বাড়ি দেখলে আমার কেমন কৌতূহল হয় এর অতীতকে জানার জন্যে।
ভদ্রলোক বললেন, সে-সব জানতে হলে বাবার কাছে চলুন।
সঞ্জয় একটু ইতস্তত করল। রুগীর কাছে. ডাক্তার একই সময়ে দু বার গেলে রুগী ঘাবড়ে যেতে পারে।
ভদ্রলোক বললেন, আপনি ভাববেন না। আমি বাবাকে বলে আসছি।
ভদ্রলোক ওপরে চলে গেলেন। একটু পরে এসে বললেন, আসুন।
বৃদ্ধ খাতির করে সঞ্জয়কে বসালেন। বললেন, আপনি কি এ বাড়িটা সম্বন্ধেই কিছু জানতে চান?
সঞ্জয় বলল, না, শুধু এ বাড়িটাই নয়। এরকম বোধ হয় আরো অনেক পুরনো বাড়ি আছে। এই ধরুন আমি যে বাড়িটায় ভাড়া আছি
–সেটা কোথায়?
যশোর রোডের ওপরে বাঙ্গুরের কাছে। সে বাড়িটাও খুব পুরনো। তিনতলা বাড়ি। তিনতলাটা ইনকমপ্লিট। ওপরে আবার একটা ভাঙা গম্বুজের মতো আছে।
বৃদ্ধ বললেন, পুরনো বাড়ি সম্বন্ধে আপনার কৌতূহল আছে জেনে খুব ভালো লাগল। কলকাতায় বিশেষ করে মারাঠা ডিচের ওপাশের জায়গাগুলো একশো-দেড়শ বছর আগে কী ছিল তা কল্পনাই করা যায় না। এ বিষয়ে আমি একজনের নাম জানি, গোটা উল্টোডিঙি এলাকার অর্থাৎ আজ যাকে বলে লেকটাউন, কালিন্দী, বাঙ্গুর, বরাট এ-সব জায়গার ঠিকুজি-কুষ্ঠী তাঁর কণ্ঠস্থ। তাঁর নাম শিবানন্দ ভট্টাচার্য। থাকেন বাগুইহাটিতে। বয়েস একশো তিন। ইচ্ছে করলে তার কাছে যেতে পারেন।
–একশো তিন বছর বয়েস! সঞ্জয় অবাক হল।
–হ্যাঁ, এখনো তেতলা-একতলা করেন। সারাজীবন জ্যোতিষচর্চা নিয়ে থেকেছেন- জপ-তপ-ব্রহ্মচর্য—-ওসব মশাই আলাদা স্তরের মানুষ। দাঁড়ান, ওঁর ছবি দেখাচ্ছি।
এই বলে ছেলেকে ইশারা করলেন। ভদ্রলোক তখনই ভেতরে চলে গেলেন। একটু পরেই ফিরে এলেন। হাতে জীর্ণ একটা খাম। বৃদ্ধ খাম থেকে জীর্ণতর বিবর্ণ একটা ফটোগ্রাফ বের করলেন।
–এই হলেন শিবানন্দ ভট্টাচার্য। আর তাঁর পদতলে আমি।
সঞ্জয় ছবিটা দেখল। পিছনে লেখা রয়েছে–পরম স্নেহাস্পদ শ্রীমান কপিলেশ্বর চৌধুরীকে মেহোপহার। নিচে তার স্বাক্ষর। সেই সঙ্গে ঠিকানা।
–ছবিটা আপনি নিয়ে যান। বয়েসের জন্যে ওঁর মেজাজটা এখন রুক্ষ হয়ে গেছে। যদি আপনি দেখা করতে যান তাহলে এই ছবিটা দেখিয়ে বলবেন আমি পাঠিয়েছি। তা হলে উনি বোধহয় আপনাকে ফিরিয়ে দেবেন না।
.
ছবিটা কাল রাত্তিরে আর বের করা হয়নি। বাইরের ঘরে ব্যাগের মধ্যেই ছিল।
ছবিটা রীণা খুব মনোযোগের সঙ্গে দেখছিল। সঞ্জয় চায়ের পেয়ালায় চুমুক দিয়ে বলল, কি এত দেখছ?
–এত বয়েস কিন্তু চোখ দুটো দ্যাখো যেন জ্বলছে। মনে হচ্ছে যেন ত্রিকালদশী কোনো সাধক।
বলতে বলতে রীণার দু চোখও যেন কেমন অস্বাভাবিক হয়ে উঠল।
সঞ্জয় অবাক হয়ে বলল, অমন করে দেখছ কেন?
–এঁকে কোথায় যেন দেখেছি। কোথায়
–এঁকে আবার দেখবে কি করে? বহুকাল কলকাতার বাইরে যাননি। তুমিও বড়ো একটা কলকাতায় আসনি।
রীণ কোনো উত্তর দিল না। হঠাৎ উঠে বিছানায় শুয়ে পড়ল।
কী হল?
–মাথার ভেতরটা কিরকম করছে!
১.২ আবার রহস্য
০৬. আবার রহস্য
আবার সেই নিঃসঙ্গ দুপুর।
সকালবেলায় সঞ্জয় চলে গেছে। তারপর রীণা পুপুকে স্নান করাল, খাওয়ালো, ঘুম পাড়াল। এক ফাঁকে নিজের নাওয়া-খাওয়াও সেরে নিল। সব চুকতে ঢুকতে বেলা একটা। এই পর্যন্ত বেশ কাটে। এর পরের চারটে ঘণ্টাই এখন সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। কিছুদিন আগে পর্যন্ত দুপুরে একটু ঘুমোত কিংবা বন্দনার মায়ের সঙ্গে গল্প করত। কিন্তু এখন ঘুম তেমন আসে না। দোতলায় যেতেও ইচ্ছে করে না। বন্দনার মা মানুষটি খুবই ভালো। সরল সাদাসিধে। অনেক মহিলার যেমন পরের সংসারের ব্যাপারে অহেতুক কৌতূহল থাকে এঁর সেরকম কিছু নেই। যে যা বলে শুনে যান। নিজের সংসারের সাধারণ ব্যাপার অকপটে বলেন। তাই এঁকে ভালো লাগে। মনে প্যাঁচ নেই। কিন্তু ইদানীং তার কাছেও আর যাচ্ছে না। সঞ্জয় বলে দিয়েছে, সাবধান, ওসব কথা যেন বলে ফেলো না। রীণার ভয়, কথায় কথায় যদি বলে ফেলে।