হঠাৎ শব্দটা থেমে গেল।
শব্দটা কোথায় এসে থামল দেখার জন্যে ঘাড় ফেরাতেই রীণার শরীরটা হিম হয়ে গেল। দেখল আবছা একটা মূর্তি তাদের বসার ঘরে টেবিলের কাছে দাঁড়িয়ে রয়েছে। পরনে যেন কালো কোট, কালো প্যান্ট।
রীণা শুয়ে শুয়েই মানুষটাকে বোঝবার চেষ্টা করতে লাগল। না, চোখের ভুল নয়। একটা মানুষই। কিন্তু এত আবছা কেন? লোকটা কে হতে পারে?
পুপু আবার কেঁদে উঠল। সঙ্গে সঙ্গে রীণা সচেতন হয়ে উঠল।
–ওগো, শুনছ! রীণা চাপা গলায় সঞ্জয়কে ডাকল। ওঠো না। তোমায় বোধহয় কেউ ডাকতে এসেছে।
–আমায়? কোথায়?
–ঐ যে বাইরের ঘরে। টেবিলের কাছে।
অন্ধকারের মধ্যে যতদূর সম্ভব দৃষ্টি তীক্ষ্ণ করে সঞ্জয় তাকাল, কই? কেউ তো নেই।
রীণা বিরক্ত হয়ে বলল, ঐ তো দাঁড়িয়ে রয়েছে।
সঞ্জয় তাড়াতাড়ি উঠতে গিয়ে কিসে যেন ধাক্কা খেল। মশারির দড়িটা ছিঁড়ে গেল। অন্ধকারে দেওয়াল হাতড়ে সুইচ নামিয়ে দিল। আলো জ্বলল না। লোডশেডিং।
সঞ্জয় বিছানা থেকে বড়ো টটা নিয়ে জ্বালল। আর ঠিক তখনই কি যেন পড়ে ঝনঝন করে ভেঙে গেল।
টর্চের আলো অন্ধকার দুফাঁক করে সোজা সিঁড়ির মুখে গিয়ে পড়ল।
কই? কোথায়?
–ঐ যে বাথরুমের দিকে। ঐ যে ঢুকছে রীণা চিৎকার করে উঠল।
সঞ্জয় টর্চ হাতে সেই দিকে ছুটল।
–যেয়ো না, যেয়ো না
সে কথায় কান না দিয়ে সঞ্জয় দৌড়ে বাথরুমে ঢুকল।
কিন্তু কোথায় কে? শুধু ফ্ল্যাশের পুরনো ট্যাঙ্ক চুঁইয়ে ফোঁটায় ফোঁটায় জল পড়ে যাচ্ছে।
–তোমার যত আজগুবি কাণ্ড! বলতে বলতে সঞ্জয় ঘরে ফিরে এল।
কী আজগুবি কাণ্ড? কেমন একরকম তীব্র তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে রীণা তাকাল। সে দৃষ্টি অস্বাভাবিক। সঞ্জয় সতর্ক হল। আর কিছু বলল না।
সে রাত্তিরে দুজনের কারোরই ভালো করে ঘুম হল না। সঞ্জয় খুবই বিরক্ত। বিরক্ত হবার কারণও আছে। সারাদিন হাসপাতালে ডিউটি গেছে। ডিউটির পরও রুগী দেখতে ছুটতে হয়েছে। তারপর আবার এই ব্যাপার। রাত্তিরটুকুতেও যদি ঘুম না হয় তাহলে তো আর পারা যায় না। অন্ধকারেই কোনরকমে মশারির দড়ি ঠিক করে একটা সিগারেট ধরিয়ে বলল, ঠিক কি দেখেছ বলো তো?
রীণা তখন অনেকটা স্বাভাবিক। সব ব্যাপারটা বলল।
সঞ্জয় কিছুটা বিরক্তি, কিছুটা বিদ্রুপের সুরে বলল, আবার সেই ব্ল্যাক স্যুট! কি করে ভাবতে পারলে রাত দুপুরে একজন লোক এসে বাইরের ঘরে ঢুকেছে? এটা কি সম্ভব? দরজাটাও তো তুমি নিজে বন্ধ করেছিলে। ঐ দ্যাখো, দরজা এখনো বন্ধ। বলেই মশারির ভেতর থেকেই দরজার ওপর টর্চ ফেলল।
রীণা চুপ করে রইল। তারপর শুকনো গলায় বলল, কি একটা পড়ে ভেঙেছে।
সঞ্জয় বলল, সেও তোমার উর্বর মস্তিষ্কের কল্পনা। কই আমি তো ভাঙার চিহ্নমাত্রও দেখতে পেলাম না।
রীণা কোনো একটিরও উত্তর দিতে পারল না। বালিশে মুখ গুঁজে শুয়ে পড়ল।
সঞ্জয় হেসে বলল, নাঃ, তোমার দেখছি নার্ভ ফেল করছে। এরপর মাথাটা একেবারে যাবে।
–বিশ্বাস করো
রীণা মিনতির স্বরে আরো কি বোঝাতে যাচ্ছিল, সঞ্জয় বলল, ও সব কথা থাক। এখন একটু ঘুমোও তো। বলে নিজেই পাশবালিশ আঁকড়ে শুয়ে পড়ল।
.
সকালের রোদ খাটের ওপর পর্যন্ত উঠে এসেছে। সঞ্জয় তখনো ঘুমোচ্ছে। হয়তো আরো কিছুক্ষণ ঘুমোত। কিন্তু রীণার ডাকে ঘুম ভেঙে গেল।
–এ-ই শুনছ?
–উ।
–একবার এসো না।
দূর বাবা, ওখান থেকেই বলো না।
–বললে হবে না। তাড়াতাড়ি এসো।
উঃ! জ্বালালে! সকাল থেকেই
ঘুম জড়ানো চোখে সঞ্জয় উঠে এল।
–এসো এইখানে। এটা কি? রীণা আঙুল দিয়ে মেঝেটা দেখাল।
সঞ্জয় দেখল টেবিলের নিচে একটা গেলাস ভেঙে পড়ে আছে।
রীণা দুহাত কোমরে রেখে বলল, খুব তো বলেছিলে আমি পাগল হয়ে গেছি। এখন নিজের চোখেই দ্যাখো।
সঞ্জয় হেঁট হয়ে কাচগুলো পরীক্ষা করতে লাগল। গেলাসটা উঁচু জায়গা থেকেই পড়ে ভেঙেছে। কেউ যেন টেবিল থেকে গেলাসটা ইচ্ছে করে ফেলে দিয়েছে।
এখন বুঝছ?
সঞ্জয় বাসি মুখেই একটা সিগারেট ধরাল। একমুখ ধোঁয়া ছেড়ে বলল, বলতে চাও ভূতে গেলাস ভেঙেছে?
–আমি আর কি বলব? তুমি নিজেই দ্যাখো।
–টেবিলের ধারে গেলাসটা রেখেছিলে, টিকটিকি-ফিটিকিতে ফেলে দিয়েছে।
না কক্ষণো ধারে রাখিনি। গেলাস কেউ টেবিলের ধারে রাখে না।
সঞ্জয় কোনো উত্তর দিল না। খোলা দরজা দিয়ে বাইরের দিকে তাকিয়ে সিগারেট খেতে লাগল। কিছুক্ষণ পরে হেসে বলল, এতে মাথা ঘামাবার কিছু নেই। বেড়ালের কাজ। যাও, এখন বেশ ফাস্ট ক্লাস করে চা করো দিকি। মেজাজটা আসুক। আমি ততোক্ষণ আর একটু শুই। বলে সঞ্জয় আবার বিছানায় গিয়ে শুয়ে পড়ল।
রীণা দাঁড়িয়ে রইল জানলার সামনে। উদ্ভ্রান্ত মন। শহর কলকাতা জেগেছে। অতি পরিচিত সকাল। কিন্তু দিনের শুরু থেকেই মনটা ভারী হয়ে রইল।
.
০৫.
একখানি ছবি
হাসপাতালে বেরোবার সময়ে রীণা বলল, সন্ধের মধ্যে ফিরবে কিন্তু।
সঞ্জয় হেসে বলল, বাইরে বেশিক্ষণ থাকার তেমন কোনো আকর্ষণ এখনো পর্যন্ত নেই।
ঠাট্টা রাখো। সন্ধেবেলা লোডশেডিং হলে আমার খুব ভয় করে।
জুতোর ফিতে বাঁধতে বাঁধতে সঞ্জয় বলল, খাস কলকাতা শহরে থেকেও ভয়? তাও তো তিনতলার ওপর।
উত্তরের অপেক্ষা না করে তাড়াতাড়ি চলে যাচ্ছিল, রীণা বলল, আমার জিনিসগুলো আনতে ভুলো না।
–না, ভুলব না। তবে তুমিও একটা কথা মনে রেখো, রাত্তিরের ব্যাপারগুলো যেন তোমার বান্ধবীটিকে বলো না। এক কান থেকে পাঁচ কানে চলে যাবে। লজ্জায় মুখ দেখাতে পারব না।