চিন্তায় বাধা পড়ল। দরজায় ঠুকঠুক শব্দ। সুনয়নী চমকে উঠল। নিজের অজ্ঞাতসারেই আর্তনাদ করে উঠল–না না না
নিচু গলায় বাইরে থেকে কে যেন বলল, সুনয়নী, ভয় নেই। দরজা খোলো।
ভয় নেই! তবু ভয়ে ভয়েই সুনয়নী দরজা খুলে দিল। সঙ্গে সঙ্গে একটা ছায়ার মতো ঘরে এসে ঢুকল অবিনাশের স্ত্রী।
–আপনি!
পদ্মা ঠোঁটের ওপর আঙুল চেপে ইশারায় বলল, চুপ! শীগগির পালাও।
সুনয়নী যেন নিজের কানকেও বিশ্বাস করতে পারল না। অস্ফুটস্বরে বলল, পালাব!
–হ্যাঁ, হ্যাঁ, পালাবে। পালাবে না তো কি মরবে? ছেলেমানুষ তুমি। তোমায় আমি নষ্ট হতে দেব না।
সুনয়নী হাত জোড় করে বলল, কি করে যাব?
পদ্মা গলার স্বর যতটা সম্ভব নিচু করে বলল, সিঁড়ির দরজা খুলে রেখেছি। একটু সাহস করে বেরিয়ে পড়ো।
–কিন্তু তারপর? এই রাতে যাব কোথায়?
পদ্ম বিরক্ত হয়ে বলল, যমের বাড়ি। তোমার কি এখান থেকে যেতে ইচ্ছে নেই?
সুনয়নী কান্না-জড়ানো স্বরে বলল, আমি এখুনি যাচ্ছি। পথ-ঘাট চিনি না। তাই
বলেই সুনয়নী ঘর থেকে বেরিয়ে যাচ্ছিল, পদ্মা হাত চেপে ধরল।
দাঁড়াও। পাগলের মতো যেও না। যা বলি মন দিয়ে শোনো। এইটে রাখো। বলে কাপড়ের ভেতর থেকে একটা পিস্তল বের করে সুনয়নীর হাতে দিল।
–এটা কি? আঁৎকে উঠল সুনয়নী।
–গুলিভরা পিস্তল। এইটে টেনে দিলেই গুলি ছুটে যাবে। অনেক কষ্টে সরিয়ে রেখেছি। এটা আমার জন্যেই সরিয়ে রেখেছিলাম। কিন্তু এখন দেখছি তোমার দরকার বেশি।
–কিন্তু
–না, কিন্তুটিন্তু নয়। ধরো এইভাবে। শক্ত করে ধরো। যদি ও টের পায়–তোমায় ধরতে যায় তাহলে সঙ্গে সঙ্গে গুলি করে মারবে। আর তুমি যদি ধরা পড়ে যাও তা হলে আত্মঘাতী হবে। বুঝলে?
সুনয়নী কোনোরকমে মাথা নেড়ে সায় দিল।
–যাও।
পদ্মাকে প্রণাম করে সুনয়নী চলে যাচ্ছিল, পদ্মা পিছু ডাকল। –শোনো। কাল দেখেছিলাম আমাদের পাড়ার জ্যোতিষী শিবানন্দ ভট্টাচার্য কয়েকজনকে নিয়ে বাড়ির সামনে ঘোরাফেরা করছিল। লোকটি ভালো। তোমার সৌভাগ্য হলে আজও হয়তো পথে ওঁকে পাবে। যদি পথে দেখা না পাও তাহলে ওঁর বাড়িতে চলে যাবে। পথের ও পাশে বেলগাছওলা যে একতলা বাড়ি–ওটাই শিবানন্দ ঠাকুরের বাড়ি। যাও। জয় মা শঙ্করী! বলে পদ্মা দুহাত কপালে ঠেকাল।
সবই হল–শুধু পদ্মাদেবী যদি সঙ্গে একটা টর্চ দিতে পারতেন।
খুব তাড়াতাড়ি সরু আঁকাবাঁকা সিঁড়ি দিয়ে নামছিল সুনয়নী। পা দুটো কাঁপছিল থরথর করে। হঠাৎই কিসে পা বেধে হোঁচট খেল। সঙ্গে সঙ্গে সেটাও শব্দ করে সিঁড়ি থেকে গড়িয়ে পড়ল।
সেই শব্দে ঘুম ভাঙল অবিনাশের। নিজের ঘর থেকেই চেঁচিয়ে উঠল–কে?
তারপরই শোনা গেল ভারী পায়ের শব্দ। তিনতলা থেকে নেমে আসছে অবিনাশ বক্সী। দুচোখ জ্বলছে হিংস্র পশুর মতো।
–সু-নয়-নী—
মূর্তিমান বিভীষিকা তাড়া করে আসছে। সুনয়নী তখনো দরজার কাছে পৌঁছতে পারেনি। হোঁচট খেয়ে সেও গড়িয়ে পড়েছিল সিঁড়ি থেকে। অবিনাশ তিন ধাপ উঁচু সিঁড়ি থেকে ঝাঁপিয়ে পড়ল সুনয়নীর ওপর।
–এইবার
–ছাড়ো, ছাড়ো বলছি
— ছাড়ছি। বলে অবিনাশ আঁচল চেপে ধরতেই সুনয়নীর হাতের পিস্তল গর্জে উঠল।…
.
শিবানন্দ ভট্টাচার্য থামলেন। দুবার কেশে নিয়ে বললেন, এইভাবেই পিশাচ অবিনাশ বক্সী সুনয়নীর হাতে পাপের প্রায়শ্চিত্ত করল। আগের রাত থেকে আমার লোকেরা অবিনাশের বাড়ির ওপর লক্ষ্য রাখছিল। তারা উদ্ভ্রান্ত সুনয়নীকে আমার কাছে নিয়ে এল। আমি প্রতিজ্ঞা করেছিলাম সুনয়নীকে নষ্ট হতে দেব না। তার স্বামীর কাছে ফিরিয়ে দেবই। আমার প্রতিজ্ঞা রক্ষা হয়েছে।
বলে বৃদ্ধ শিবানন্দ কঁপা কাঁপা দুই হাত তুলে ভগবানের উদ্দেশে প্রণাম জানালেন।
-তারপর?
–তারপর কি হতে পারে আপনারা অনুমান করে নিন। অবিনাশের অতৃপ্ত আত্মা নিশ্চয় ঐ গোলবাড়িতে অপেক্ষা করেছিল বছরের পর বছর, কবে সুনয়নীকে পাবে। সে বোধহয় এমনই ক্ষমতার অধিকারী হয়েছিল যে এত বছর পরেও আকর্ষণ করে এনেছিল নতুন প্রজন্মের সুনয়নীকে। কিন্তু সৌভাগ্য–এবারেও চরম ক্ষতি করতে পারল না।
সঞ্জয় আশ্চর্য হয়ে বলল, আপনার মতে কি রীণাই সে সুনয়নী?
–তাই তো মনে হয়। রহস্যময় জন্মান্তরবাদের ওপর কে শেষ কথা বলবে?
–আমি বিশ্বাস করি না।
শিবানন্দর চোয়াল শক্ত হল। উত্তেজিত গলায় বললেন, সেটা আপনার অভিরুচি। এ ব্যাপারে আমি আপনার সঙ্গে তর্ক করব না। আপনারা একটা পুরনো বাড়ির খবর জানতে এসেছিলেন আমি খবরের সঙ্গে একটা বিশেষ ঘটনাও জানিয়ে দিলাম। যে ঘটনার সঙ্গে আমিও জড়িয়ে ছিলাম।
একটু থেমে বললেন, তবে আপনার স্ত্রীকে দেখতে পেলে অন্তত নিজের কাছে নিজে পরিষ্কার হয়ে যেতাম।
ডাক্তার রুদ্র পকেট থেকে সঞ্জয় আর রীণার ছবিটা বের করে বললেন, দেখুন তো এই ছবিটা।
শিবানন্দ ছবিটা হাতে নিয়ে চোখের খুব কাছে ধরে দেখতে লাগলেন। তার পর নাতিকে বললেন, আমার তেরো নম্বর কাগজের বাণ্ডিলটা নিয়ে এসো তো!
ভদ্রলোক তখনি ভেতরে চলে গেলেন। শিবানন্দ তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে রীণার ছবিটা দেখতে লাগলেন।
মিনিট দশেক পরে নাতি পুরনো দড়ি দিয়ে বাঁধা একটা ফাইল নিয়ে এলেন।
ধুলো ঝেড়ে শিবানন্দ সেটা খুলে একগাদা কাগজপত্রের মধ্যে থেকে বের করলেন আর এক দম্পতির ফটো। ফটোটার রঙ হলদেটে হয়ে গেছে। চারিদিকে পোকায় কেটেছে।