এবার আমিই বলব। যে উদ্দেশ্যে আপনারা এসেছেন এবার তা জানতে পারবেন।
শিবানন্দ কয়েকবার কেশে গলাটা পরিষ্কার করে নিলেন। তারপর ভাঙা ভাঙা গলায় বলতে লাগলেন–
–মগরার এই মেয়েটির নাম সুনয়নী তা আপনারা জেনেছেন। সেই সুনয়নী একরাত্রি আমার পরিবারের সঙ্গে ছিল। আমি তাকে আশ্রয় দিয়েছিলাম। ত্রিবেণী থেকে তুলে আনার পর থেকে যা যা ঘটেছিল তা ও আমায় বলেছিল। সেই ঘটনাটা বলি।
.
০৩.
সুনয়নী-উপাখ্যান
গভীর রাত্রে সুনয়নীর মুখ কাপড় দিয়ে বেঁধে অবিনাশ আর তার এক সঙ্গী তাকে মোটর থেকে নামিয়ে বিরাট কম্পাউন্ডওয়ালা বাড়ির দোতলার একটা ঘরে আটকে রাখল।
সুনয়নী পড়ে পড়ে গোঙাতে লাগল। কিন্তু কথা বলতে পারল না। মুখ বাঁধা।
সুনয়নী দেখল ঘরটা বেশ বড়ড়া। কিন্তু অন্ধকার। ঘণ্টাখানেক পরে রাত তখন ঠিক কত জানে না, মনে হল কেউ একজন দরজার বাইরে এসে দাঁড়াল। তারপর ঝনাৎ করে শেকল খুলে ঘরের ভেতর এসে ঢুকল।
কালো কোট-প্যান্ট-পরা সেই ম্যাজিসিয়ান। হাতে তার খাবার।
ম্যাজিসিয়ান থালা বাটি একটা টেবিলের ওপর রেখে সুনয়নীর মুখের বাঁধন খুলে দিল। সুনয়নী তার দুপা জড়িয়ে ধরল।
ম্যাজিসিয়ান পা দিয়েই তাকে ঠেলে দিয়ে বলল, খাবার রইল। কুঁজোয় জল আছে। না খেলে লাভ নেই। কেননা তোমাকে এখন নতুন করে বেঁচে থাকতে হবে। কাল রাত্তিরে আবার দেখা হবে।
বলেই ঘরের বাইরে বেরিয়ে গিয়ে দরজার শেকল তুলে দিল।
পরের দিন সকাল, দুপুর, বিকেল কেটে গেল। ম্যাজিসিয়ান আর আসেনি। ঝি আবার খাবার দিয়ে গেল।
–ও মা! সব খাবারই যে পড়ে আছে। কিছুই তো খাওনি। না খেয়ে লাভ নেই বাছা। এসে যখন পড়েছ–
বলে আর এক থালা রেখে দিয়ে গেল।
অনেক রাত্তিরে বাড়ির সামনে মোটর গাড়ির শব্দ। একটা গাড়ি যেন কম্পাউন্ডের মধ্যে ঢুকল। তারপর গাড়ির দরজা খোলার আর বন্ধ করার শব্দ।
সুনয়নী ভাবল–নিশ্চয় পুলিশ এসেছে তাকে উদ্ধার করতে। এই মনে করে রুদ্ধ নিশ্বাসে অপেক্ষা করতে লাগল।
একটু পরেই দরজার শেকল খোলার শব্দ। সুনয়নী চমকে উঠল। দেখল দরজা খুলে ঢুকছে অবিনাশ বক্সী। সঙ্গে পুলিশের পোশাক-পরা একজন ফিরিঙ্গি সাহেব।
–উঠে এসো। অবিনাশ বক্সী কঠিন স্বরে যেন আদেশ করল।
–উঠে এসো বলছি।
–না। বলে চিৎকার করে সুনয়নী ভয়-বিস্ফারিত চোখে তাকিয়ে রইল।
তখন অবিনাশ বক্সী এগিয়ে গিয়ে ওর হাত ধরে টানতে গেল। কাছেই ছিল টেবিলটা। সুনয়নী প্রাণপণে টেবিলের পায়া আঁকড়ে ধরে রইল। তার দুচোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ল। –আমায় দয়া করে ছেড়ে দিন। এই আমি আপনাদের পায়ে পড়ছি।
অবিনাশ বক্সী লাথি মেরে বলল, হ্যাঁ, ছাড়ছি। নিচে চল।
সুনয়নী হাত জোড় করে বলল, দোহাই আপনাদের। আমি বিবাহিতা। আমার স্বামী আছেন। তিনি এখনও পাগলের মতো খুঁজে বেড়াচ্ছেন।
অবিনাশ বলল, তোমার স্বামী তোমাকে নিশ্চয় ফিরে পাবে। তবে সাত দিন পর।
এই সময়ে ফিরিঙ্গি পুলিশ অফিসার বললেন, আজ না হয় থাক মিঃ বক্সী। আগে ও পোষ মানুক।
-না না, এ-সব মেয়ে কোনোদিনই পোয মানবে না। আজই—
বলে সুনয়নীকে জোর করে টেনে তুলতেই সুনয়নী মরিয়া হয়ে আচমকা অবিনাশকে একটা ধাক্কা মারল। অবিনাশ হুমড়ি খেয়ে মাটিতে পড়ে গেল। আর সেই ফাঁকে সুনয়নী খোলা দরজা দিয়ে বেরিয়ে খাড়া সিঁড়ি দিয়ে নামতে লাগল।
অবিনাশ তখনই উঠে দাঁড়িয়ে চিৎকার করে উঠল–সাবধান!
সঙ্গে সঙ্গে পকেট থেকে পিস্তল বের করে ফায়ার করল।
উঃ মাগো! বলে সুনয়নী সিঁড়িতে লুটিয়ে পড়ল।
ঠিক তখনই তিনতলা থেকে একটি স্ত্রীলোক ছুটে নেমে এল।
–এ কী করলে! মেয়েটাকে মেরে ফেললে!
সামনে যে একজন ফিরিঙ্গি পুলিশ অফিসার রয়েছে স্ত্রীলোকটি তা গ্রাহ্যও করল না।
–না, মারিনি। ভয় দেখিয়েছি শুধু। এমন জিনিস কি মেরে ফেলা যায়? কিন্তু ঘর থেকে তুমি বেরিয়ে এলে যে? তোমায় না বারণ করেছিলাম, আমি না ডাকলে তুমি বেরোবে না।
স্ত্রীলোকটি চেঁচিয়ে উঠে বলল, হ্যাঁ জানি। শুধু সাহেব-মেমদের সামনে তোমার স্ত্রী হয়ে দেখা দেওয়া ছাড়া আমার বের হওয়া তুমি চাও না। কিন্তু কিন্তু কি করব? অসহায় এক-একটি মেয়েকে ধরে এনে তুমি তাদের সর্বনাশ করবে এ আর আমি কতদিন সহ্য করব?
–আঃ পদ্মা! চলে যাও বলছি।
যাচ্ছি। তার আগে দেখব মেয়েটি বেঁচে আছে কিনা। যদি মরে গিয়ে থাকে তাহলে আমিই তোমায় পুলিশে দেব। আর তুমিই বা কিরকম পুলিশ-সাহেব, চোখের সামনে নিরীহ মেয়েটাকে গুলি করল তবু হাঁ করে দেখছ?
ফিরিঙ্গি পুলিশ অফিসার তাড়াতাড়ি সুনয়নীর কাছে এগিয়ে গেল। দেখল গুলি লাগেনি।
কোনো কথা না বলে ফিরিঙ্গি অফিসার মাথা নিচু করে সিঁড়ি দিয়ে নামতে লাগল। অবিনাশ ছুটে গেল। হাত জোড় করে বলল–স্যার, আপনি চলে যাচ্ছেন?
–হ্যাঁ, আজ থাক। পরে একদিন
বলতে বলতে ফিরিঙ্গি পুলিশ গাড়িতে গিয়ে উঠল।
সেদিনের মতো সুনয়নী বেঁচে গেল।
.
পরের দিন।
গভীর রাত্রি। অন্ধকার ঘরে দেওয়ালে ঠেসান দিয়ে নিজের ভাগ্যের কথা সুনয়নী ভাবছিল। একদিন ভাগ্যক্রমে রক্ষা পেয়েছে। আজ না জানি কি হয়!
তার মনে পড়ছিল বাড়ির কথা। না জানি তার স্বামী কি করছে? কোথায় খুঁজে খুঁজে বেড়াচ্ছে। আর বুড়ো শ্বশুর? সুনয়নী নইলে যাঁর একবেলা চলত না? না জানি কেঁদে কেঁদে বোধহয় অন্ধ হয়েই গেলেন!