এবার গৃহকর্তা বিরক্ত হয়ে বললেন, আপনি তো অনেক উপদেশ বর্ষণ করলেন। কিন্তু আমি স্পষ্ট কথাই বলছি, তাকে আর ঘরে তোলা সম্ভব হবে না।
দাদু দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে বললেন, তাহলে আমার আর বলার কিছু নেই। নিরপরাধ একটা মেয়েকে আপনি পাপের পথেই ঠেলে দিচ্ছেন। দেখবেন ধর্মে সইবে না। বলে দাদু তখনই বেরিয়ে এলেন।
মাত্র কিছুদূর গিয়েছেন, পিছন থেকে কে ডাকলঠাকুরমশাই!
দাদু ফিরে তাকালেন। দেখলেন একটি যুবক হাত জোড় করে দাঁড়িয়ে। যুবকটিকে দাদু গৃহকর্তার ঘরেই দেখেছিলেন। গৃহকর্তার সঙ্গে দাদু যখন কথা বলছিলেন, যুবকটি তখন একপাশে দাঁড়িয়ে শুধু শুনছিল।
আপনি? দাদু জিগ্যেস করলেন।
যুবকটি হাত জোড় করে বললেন, আজ্ঞে যে নিখোঁজ হয়েছে সে আমারই স্ত্রী। আমি সব শুনলাম। আপনি যদি ওকে উদ্ধার করে দিতে পারেন তাহলে আমি চিরকৃতজ্ঞ থাকব।
দাদু কাছে এগিয়ে এসে যুবকের কাঁধে হাত রেখে বললেন, আমি সন্ধান জানি মাত্র। যে দুবৃত্ত আপনার স্ত্রীকে ভুলিয়ে নিয়ে গেছে তাকেও আমি চিনি। সে ঐ ম্যাজিসিয়ান। থাকে কলকাতায় আমার বাড়ির কাছে। কিন্তু আপনার স্ত্রীকে উদ্ধার করতে হলে থানার সাহায্য চাই। আর তার জন্যে আপনাকে গিয়ে ডায়েরি করতে হবে।
যুবকটি মাথা নিচু করে কী চিন্তা করতে লাগল।
দাদু ক্ষোভের হাসি হেসে বললেন, বুঝেছি, আপনার বাবার মতের বিরুদ্ধে যাওয়ার সাহস আপনার নেই। তাছাড়া উদ্ধার করেই বা কি হবে? তাকে তো আর ঘরে তুলতে পারবেন না।
এবার যুবকটি নিচু গলায় বলল, দেখুন, থানা-পুলিশ করতে পারব না। কিন্তু সুনয়নীকে পেলে আমি তাকে গ্রহণ করবই।
দাদু আবার একটু হাসলেন। বললেন, কি করে?
দরকার হলে বাড়ি থেকে আমি আলাদা হয়ে যাব। দাদু খুশি হয়ে যুবকের পিঠ চাপড়ে বললেন, ঠিক আছে। আমি একাই চেষ্টা করে দেখি। তবে মনে রাখবেন তাকে উদ্ধার করতে পারলে আপনি কিন্তু ত্যাগ করতে পারবেন না। কথা দিয়েছেন। দরকার হলে কলকাতায় এসে আমার বাড়িতে থাকবেন।
যুবকটি অঙ্গীকার করে কৃতজ্ঞচিত্তে বাড়ি ফিরে যাচ্ছিল, দাদু ফের ডাকলেন। বললেন, বৌমার কোনো ছবি আছে?
যুবকটি একটু ভেবে বলল, বোধহয় আছে।
–তাহলে আমি এখানে দাঁড়াচ্ছি। আপনি নিয়ে আসুন। থানায় ছবি দেখাতে হবে।
দাদু দাঁড়িয়ে রইলেন। একটু পরে যুবকটি একটা ছবি কাগজে মুড়ে দাদুকে এনে দিল।
নাতি ভদ্রলোক একটু থামলেন।
ডাক্তার রুদ্র ব্যস্ত আগ্রহে বললেন, তারপর?
দাদু এবার তুমি বলবে?
না, তুমিই বেশ বলছ। বলে যাও ভুল হলে শুধরে দেব।
–তারপর দাদু একাই ত্রিবেণী থানায় গেলেন। থানা অফিসারকে সব কথা। বললেন। থানা অফিসার সব শুনলেন। তারপর বললেন, ঘটনাটা আমার থানায় ঘটলেও সেই ম্যাজিসিয়ানের বাড়ি সার্চ করতে পারে একমাত্র কলকাতার পুলিশ। আপনি ওখানকার থানায় জানান। আমিও তাদের রিকোয়েস্ট করছি।
দাদু ভেবে দেখলেন কথাটা ঠিক। তিনি কলকাতায় ফিরে এসে নিজেই থানায় সব জানালেন।
কিন্তু তার ফল যে উল্টো হবে দাদু তা ভাবতে পারেননি।
ঠিক দুদিন পর।
সকালে দাদু একটা বই পড়ছিলেন। এমনি সময়ে বাড়ির সামনে একটা হুড-খোলা গাড়ি এসে দাঁড়ালো।
নিশ্চয় কোনো সাহেবসুবো এসেছে ভেবে তাড়াতাড়ি গায়ে ফতুয়াটা চড়িয়ে নিলেন। ঠিক তখনই দাদুকে হতচকিত করে সদর্পে ঘরে ঢুকল অবিনাশ বক্সী। পকেট থেকে পিস্তল বের করে বলল, তুমি তো অন্যের ভাগ্যগণনা কর–বলো তো আজ তোমার ভাগ্যে কি ঘটতে যাচ্ছে?
দাদু কোনো উত্তর দিলেন না। একটু হাসলেন।
–হাসছ? শেষ হাসি হেসে নাও। তারপরেই আমার শত্রুতা করার চরম ফল ভোগ করবে। বলে পিস্তলটা উঁচু করে ধরল।
দাদু তখনও অবিনাশের দিকে তাকিয়ে মিটিমিটি হাসছেন।
–তোমার এত বড়ো স্পর্ধা তুমি থানায় জানিয়ে এসেছ ত্রিবেণী থেকে আমি একটি মেয়েকে ধরে নিয়ে এসেছি! তাঁ, এনেছি। সে এখন আমার ঘরে। পুলিশের বাবার সাধ্য নেই তাকে উদ্ধার করে। তারা আমার কেনা। শুধু কেনাই নয়, থানায় যে অফিসারটিকে তুমি জানিয়েছ, সুনয়নীকে প্রথম সেই ভোগ করবে। কিন্তু তুমি যখন জেনেছ তখন তোমার মুখ বন্ধ করতেই হয়। বলতে বলতে দরজার কাছ থেকে দাদুর দিকে এগিয়ে আসতে লাগল।
ঠিক সেই সময়ে একটা গাড়ি এসে বাড়ির সামনে দাঁড়াল। গাড়ি থেকে নামল একজন সাহেব আর মেম। অবিনাশ চট করে পিস্তলটা লুকিয়ে ফেলল। দাঁতে দাঁত চেপে বলল–সাত দিন সময় দিলাম। এর মধ্যে কলকাতা ছেড়ে চলে যাবে। সাত দিন পর আবার আসব। সেদিনও যদি দেখি তুমি রয়েছ তাহলে
কথা শেষ না করেই অবিনাশ গাড়িতে গিয়ে উঠল।
দাদু এগিয়ে গেলেন দরজা পর্যন্ত। হেসে বললেন, বক্সী সাহেব, সাত দিন কেন আরও অনেক দিন পর্যন্ত এখানেই আমি থাকব। কিন্তু সাত দিন পর তুমি আর থাকবে না। চরম মুহূর্তে চেষ্টা কোরো আমার ভবিষ্যদ্বাণী স্মরণ করতে।
বক্সী হা হা করে হেসে উঠল। বলল, আচ্ছা দেখা যাবে কে থাকে। বলেই গাড়িতে স্টার্ট দিল।
শিবানন্দ ভট্টাচার্যের নাতি এই পর্যন্ত বলে থামলেন।
-তারপর? সঞ্জয় জিজ্ঞেস করল।
ভদ্রলোক এবার যেন চাইলেন বাকি ঘটনাটা দাদু বলেন। তিনি শিবানন্দর দিকে তাকালেন।
শিবানন্দ তাকিয়ায় হেলান দিয়ে শুয়ে পড়েছিলেন। এবার দুই কনুইয়ের ওপর ভর দিয়ে দেহটাকে কোনোরকমে ঠেলে তুললেন।