শিবানন্দ যেদিন থেকে এই খবরটা জানতে পারলেন সেদিন থেকেই অবিনাশ যখনই বাইরে টুপ নিয়ে যেত তখনই তাকে লুকিয়ে অনুসরণ করতেন হাতে-নাতে ধরার জন্যে। কিন্তু ধরতে পারেননি।
সেবার কলকাতা থেকে প্রায় পঁয়ত্রিশ মাইল দূরে ত্রিবেণীতে খেলা দেখাতে গিয়েছে। সরস্বতী নদীর ধারে অবিনাশের তাঁবু পড়েছে। শিবানন্দও তাকে অনুসরণ করে ত্রিবেণীতে হাজির।
সকাল থেকে ঘোড়ার গাড়িতে বসে ড্রাম বাজাতে বাজাতে ম্যাজিক-পার্টির লোকেরা শহর থেকে গ্রামে হ্যান্ডবিল বিলি করতে লাগল। মুখে টিনের চোঙা লাগিয়ে চেঁচাতে লাগল–আসুন দেখুন যাদুকর অবিনাশ বক্সীর অসাধারণ খেলা! কাচ ভক্ষণ! ছাগলের কাটা মুণ্ডুর ডাক! মুখের মধ্যে জ্বলন্ত আগুন! এর সঙ্গে আছে কঙ্কালের অট্টহাসি! লাস্যময়ী তরুণীদের নৃত্য! কুমারী বালিকার দ্বিখণ্ডিত লাশ! ইত্যাদি।
যথাসময়ে দলে দলে লোকে ম্যাজিক দেখতে এল। মেয়েদের সংখ্যাই বেশি। প্রচুর টাকার টিকিট বিক্রি হল। কিন্তু
অবিনাশ বক্সী শুধু টাকা পেয়েই খুশি নয়। তার শরীরে যে উচ্ছঙ্খল জমিদার বংশের রক্ত! নিত্য নতুন মেয়ে চাই তার! একবার কোনোরকমে কলকাতায় নিয়ে গিয়ে গোলবাড়িতে তুলতে পারলেই হল।
সুযোগের জন্যে প্রতিবারের মতো এবারও বক্সীকে অপেক্ষা করতে হল খেলার শেষ দিনের শেষ শো পর্যন্ত।
আজ থেকে প্রায় যাট বছর আগের কথা। গ্রামাঞ্চলে সেসময়ে রাত নটা মানে অনেক রাত। শেষ খেলাটি দেখালেন বিখ্যাত যাদুকর অবিনাশ বক্সী। হাততালিতে তবু কেঁপে উঠল। অবিনাশ বক্সীকে লাগছিল সাহেবের মতো। পরনে কালো কোট-প্যান্ট, মাথায় ফেল্টের টুপি। খেলার শেষে তিনি হাত জোড় করে বিদায় চাইলেন।
আবার তুমুল হাততালি।
এবার তাঁবু থেকে বেরোবার পালা। দলে দলে পুরুষরা বেরোচ্ছে পুরুষদের গেট দিয়ে। মেয়েরা বেরাচ্ছে অন্য পথ দিয়ে। হঠাৎ স্টেজের মধ্যে ভৌতিক চিৎকার! আসলে এও একটা খেলা। কিন্তু লোকে তা বুঝতে পারল না। তারা ভয় পেয়ে দৌড়ে পালাতে লাগল। আর ঠিক তখনই মেয়েদের দিকের ডে-লাইটটা কে যেন সরিয়ে নিয়ে গেল। সঙ্গে সঙ্গে অন্ধকার। মেয়েরা চিৎকার করে উঠল–আলো–আললা–
কিন্তু কে কার কথা শোনে! মেয়েরা পড়িমরি করে তাঁবুর বাইরে এসে পড়ল। তখন সেখানে ভিড়ে ভিড়। যে যেদিকে পারছে ছুটছে।
মেয়েদের মধ্যে যারা গ্রাম থেকে এসেছিল তারা ত্রিবেণীর পথঘাট কিছুই চেনে না। বাড়ির পুরুষদেরও অন্ধকারে খুঁজে পাচ্ছে না। দিশেহারা হয়ে এক রাস্তা থেকে অন্য রাস্তায় ছুটোছুটি করতে লাগল। মাঝে মাঝে বাড়ির লোকেরা মেয়েদের নাম ধরে ডাকছে। চেঁচামেচির মধ্যেও যে কোননারকমে শুনতে পাচ্ছে সে সাড়াও দিচ্ছে, কিন্তু তাদের মিহি গলা পুরুষদের কানে পৌঁছচ্ছে না।
এমনি সময়ে টর্চের জোরালো আলো এসে পড়ল মেয়েদের মুখে। কে টর্চ ফেলে কাকে খুঁজছে বোঝা গেল না। শুধু টর্চের আলো এক মুখ থেকে অন্য মুখে সরে সরে যেতে লাগল। যেন কেউ টর্চের আলো ফেলে বিশেষ কাউকে খুঁজছে। শেষে একটি মেয়ের মুখের ওপর আলোটা এসে থেমে গেল।
–এদিকে এসো। তোমার বাড়ির লোকেরা তাঁবুতে তোমার জন্যে দাঁড়িয়ে রয়েছে।
সরল বিশ্বাসে তরুণী নববধূটি এগোল। সঙ্গে সঙ্গে টর্চের আলোও নিভে গেল।
তারপর?
তারপর আর কেউ কিছু জানতে পারল না। শুধু একটা মোটরের গর্জন। মুহূর্তে হেডলাইটের আলোয় দুপাশের অন্ধকার ফঁক করে গাড়ি ছুটল ত্রিবেণী থেকে কলকাতার দিকে।
শিবানন্দ অন্ধকারে দাঁড়িয়ে সবই দেখলেন। পরের দিন সকালে তাঁবু গুটিয়ে অবিনাশ বক্সীর ম্যাজিক পাটি কলকাতায় ফিরে গেল। এদিকে মহা হৈহৈ কাণ্ড। সকলেই শুনলেন ম্যাজিক দেখতে এসে একটি অল্পবয়সী বৌ হারিয়ে গেছে। কেউ কেউ মন্তব্য করলেন, হারাবে আর কোথায় সুযোগ পেয়ে নাগর জুটিয়ে পালিয়েছে। মেয়েটির স্বামী দুদিন খোঁজাখুঁজি করল। তারপর হতাশ হয়ে গ্রামে ফিরে গেল।
এই পর্যন্ত বলে ভদ্রলোক একটু থামলেন। তারপর আবার বলতে লাগলেন–দাদু সন্ধান করে করে শেষে মগরায় গেলেন। তারপর যে বাড়ির বৌ হারিয়েছিল খোঁজ করে সেই বাড়িতে গিয়ে গৃহকর্তার সঙ্গে দেখা করলেন। কিন্তু দাদু আশ্চর্য হলেন যখন দেখলেন গৃহকর্তা অর্থাৎ মেয়েটির শ্বশুরমশাইটি একেবারে নির্বিকার।
–পুত্রবধূ সম্বন্ধে আপনি কি ভাবছেন? দাদু জিজ্ঞেস করলেন।
–কি আর ভাবব? তার যদি মতিভ্রম হয়ে থাকে তো কে কি করবে?
দাদু বললেন, মতিভ্রম বলছেন কেন? তাকে তো দুবৃত্তে ধরে নিয়ে গেছে।
শ্বশুরমশাই কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বললেন, তাহলেই বা কি করতে পারি? তাকে কি আর খুঁজে পাব?
–হু, পাবেন। আমি জানি তাকে কে অপহরণ করে কোথায় নিয়ে গেছে।
এ কথা শুনেও গৃহকর্তা কিছুমাত্র উৎসাহ দেখালেন না। চুপ করে রইলেন।
দাদু বললেন, আপনি আমার সঙ্গে চলুন। থানায় ডায়েরি করবেন। আমি নিজে চোখে যা দেখেছি থানায় তা বলব।
গৃহকর্তা অবাক হয়ে দাদুর দিকে তাকিয়ে রইলেন।
–হ্যাঁ, আমি সত্যি কথাই বলছি। এই দেখুন আমি ব্রাহ্মণ। এই পৈতে ছুঁয়ে বলছি–আপনি আমার সঙ্গে থাকুন আমি আপনার পুত্রবধূকে উদ্ধার করে শয়তানটাকে জেলে পুরব।
গৃহকর্তা কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বললেন, না মশাই, থানা-পুলিশ আমি করতে পারব না।
দাদু রেগে উঠে বললেন, কেন মিছিমিছি ভয় পাচ্ছেন? আমি তো রয়েছি। তাছাড়া আপনার একটি পয়সাও খরচ হবে না। সব দায়িত্ব আমার।