একবার দাদুর কাছে এক মেমকে নিয়ে আসেন দাদুর এক অনুরাগী ব্যক্তি। মেমসাহেব এদেশের অ্যাসট্রোলজারদের নিয়ে একটা বই লিখছে। তাই দাদুর ছবি তুলল। দাদুর জীবনী নিতে চাইল। তার পর হঠাৎ দাদুর সামনে হাত মেলে ধরে বলল, দেখুন তো আমার কস্তুগাল লাইফ কেমন যাবে?
নিতান্তই হালকা প্রশ্ন। দাদু কিন্তু সিরিয়াসলি মেমের হাতটা তুলে নিয়ে দেখতে লাগলেন। মিনিট তিনেক পরেই হাতটা ছেড়ে দিলেন।
–কি দেখলেন? মেম হেসে জিজ্ঞেস করল।
দাদু বললেন, বিয়ের পর তোমাদের দাম্পত্য জীবন ভালোই হবে।
মেমসাহেব কিছু বলার আগেই অনুগত ভদ্রলোকটি যেন আকাশ থেকে পড়লেন।
–বলছেন কী ভট্টাচার্যমশায়! উনি বিবাহিতা বলেই তো দাম্পত্য জীবনের কথা জানতে চাইছেন।
দাদু হেসে মাথা নাড়লেন। বললেন, না, ওঁর কররেখায় এখনো বিবাহযোগ ফোটেনি। কাজেই বিয়ে হতে পারে না। হবে কিছুদিন পরে।
মেমসাহেব কোনো কথা না বলে লজ্জিত মুখে গাড়িতে গিয়ে উঠল।
মেম চলে গেলে অনুগত লোকটি বলল, কিন্তু উনি যে স্বামী-স্ত্রীর মতো একসঙ্গে থাকেন।
দাদু বললেন, স্বামী-স্ত্রীর মতো থাকলেই কি স্বামী-স্ত্রী হয়? বিবাহ অন্য জিনিস।
–তবে ওঁরা বিয়ে করেননি কেন?
দাদু বললেন, তার উত্তর আমি কী দেব? নিশ্চয় কোনো বাধা আছে। আর সে বাধা কাটিয়ে উঠতে আরো কিছু সময় লাগবে।
আড়াই মাস পরে সেই মেমসাহেব একজন সাহেবকে নিয়ে হাসতে হাসতে এসে হাজির। সঙ্গে এক বাক্স কেক। কি দাদু, তাই তো? আমি বাবার কাছ থেকে যা শুনেছি তাই বললাম।
বৃদ্ধ একটু হেসে মাথা দোলালেন।
তারপর এই মেমসাহেবের দৌলতে সাহেব-পাড়ায় দাদুর নাম ছড়িয়ে পড়ল। তারা দলে দলে দাদুর কাছে হাত দেখাতে আসতে লাগল।
অবিনাশ ভেবেছিল সেইই একমাত্র বাঙালি যে সাহেবদের কাছে খুব পপুলার। এখন চোখের সামনে দাদুর প্রতিপত্তি দেখে হিংসেয় জ্বলতে লাগল।
একদিন এক সাহেব অবিনাশ বক্সীর বাড়ির সামনে গাড়ি থেকে নামল। অবিনাশ ভাবল, বোধহয় ম্যাজিক দেখাবার বায়না করতে এল। সাহেবকে খুব খাতির করে অভ্যর্থনা করল। কিন্তু সাহেব তাকে কোনো গুরুত্ব না দিয়ে দাদুর বাড়ি কোন দিকে জানতে চাইল।
এতেই অবিনাশ একেবারে খাপ্পা হয়ে গেল। বলল, সাহেব, আমি বুঝতে পারি না তোমরা কি করে ওর বুজরুকিতে ভুলে যাও।
সাহেব হেসে বলল, বক্সী, তোমারও যে এত খ্যাতি শুনতে পাই সেটাও কি তোমার বুজরুকির জন্যে নয়?
অবিনাশ তার কী উত্তর দিয়েছিল জানা নেই। কিন্তু তারপর থেকেই দাদুকে পাড়া-ছাড়া করার জন্যে উঠে-পড়ে লাগল। কিন্তু দাদুও খুব নির্জীব মানুষ ছিলেন না। নিজের জেদে জাঁকিয়ে প্র্যাকটিস করতে লাগলেন। কি দাদু, তাই না?
শিবানন্দ সগর্বে মাথা দোলালেন।
কারো ক্ষতি না করে, এমনকি কারও সাতে-পাঁচে না থেকেও কেমন করে যে নির্বিবাদ মানুষও শত্রু হয়ে পড়ে আমার জীবনে সেই প্রথম অভিজ্ঞতা। বলে শিবানন্দ কাশতে লাগলো।
–এইবার বক্সীকে জব্দ করার জন্যে দাদুও উঠে পড়ে লাগলেন।
বাধা দিয়ে শিবানন্দ বললেন, না, জব্দ করার জন্যে নয়। আসল কথা হচ্ছে,আপনারাও জেনে রাখুন, কেউ শত্রু হয়েছে বুঝতে পারলেই লোকটাকে পুরোপুরি জানবার চেষ্টা করা উচিত। অর্থাৎ লোকটার অর্থবল, লোকবল কি রকম, বে-আইনি কোনো কাজ করে কিনা, তার কোনো দুর্বল দিক আছে কিনা, সর্বোপরি তারও কোনো শত্রু আছে কিনা। কেননা শত্রুর শত্রু মানেই বিরুদ্ধপক্ষের মিত্র। মোটামুটি এই ব্যাপারগুলো জেনে নিতেই হয়।
শিবানন্দ একটু থামলেন। তারপর বলতে লাগলেন, যখন দেখলাম বক্সী আমায় সুনজরে দেখছে না তখনই বুঝলাম ও শত্রুতা করবে। তার পরিণতি কী হবে তাও ভেবে নিলাম। পুলিশকে ঘুষ দিয়ে বা গুণ্ডা লাগিয়ে ও আমার ক্ষতি করতে পারে। তাই তার কোথায় উইকপয়েন্ট আছে গোপনে আমি সন্ধান করতে লাগলাম। আর এইভাবে খোঁজ করতে করতেই
শিবানন্দ কথা শেষ করতে পারলেন না। দমকা কাশিতে স্বর আটকে গেল।
ওঁর নাতি তখন দাদুর কথার জের ধরে বলতে লাগলেন, খোঁজ করতে করতে দাদু জানতে পারলেন ওর টুপে যে সুন্দরী যুবতী মেয়েরা কাজ করে তারা শুধু চাকরিই করে না, বক্সীর সঙ্গে তাদের অন্য সম্পর্কও আছে।
এই সময়ে কিশোরী মেয়েটি হঠাৎ ভেতরে চলে গেল।
–দাদু ভালো করে খোঁজ খবর নিয়ে জানলেন, এই মেয়েরা একসময়ে সকলেই দূর দূর গ্রামের দরিদ্র ভদ্রঘরের ছিল। বক্সী তাদের চাকরির নাম করে নিয়ে এসে তাদের এমন অবস্থা করে দিয়েছে যে তারা আর ফিরে যেতে পারে না।
না না, সব ক্ষেত্রে চাকরির নাম করেও নয়, জোর করে, বলপ্রয়োগ করে ধরে আনত, যেমন সুনয়নীর কেস। বাধা দিয়ে এইটুকু বলেই শিবানন্দ হাঁপাতে লাগলেন।
ওঁর কষ্ট দেখে ডাঃ রুদ্র বললেন, আজ না হয় থাক। আর একদিন–
না না, আর একদিন নয়। আজই শুনে যান। সুনয়নীর কথা আপনাদের জানা দরকার। এই বলে শিবানন্দ নাতির দিকে তাকিয়ে তাকিয়ায় মাথা দিয়ে শুয়ে পড়লেন।
এরপর শিবানন্দ ভট্টাচার্যর নাতি যা বললেন তা এইরকম—
নাম, যশ, অর্থ বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ইদানীং নতুন মেয়ে সংগ্রহের পদ্ধতিটা বক্সী বদলেছিল। এখন আর মিথ্যে কথা বলে বা ধাপ্পা দিয়ে মেয়ে যোগাড় করত না। যখনই গ্রামেগঞ্জে খেলা দেখাতে যেত তখনই নিরীহ, গ্রাম্য কোনো সুন্দরী তার ফাঁদে পড়তই। আর ফাঁদটা অবিনাশ পাতত শেষ খেলার দিন।