–কি যেন আপনার নাম?
—-সঞ্জয় গুপ্ত।
–আপনিই তো ডাক্তার?
উনিও। বলে সঞ্জয় ডাঃ রুদ্রকে দেখিয়ে দিল।
–একসঙ্গে জোড়া ডাক্তার! বৃদ্ধ ঠোঁট ফাঁক করে বোধহয় একটু হাসবার চেষ্টা করলেন।
–আপনি তাহলে সপরিবারে থাকতেন?
–হুঁ।
–আপনি কোনোদিন কিছু দেখেছিলেন, বা অনুভব করেছিলেন?
না।
–যে কমাস ঐ বাড়িতে ছিলেন তার মধ্যে আপনার বাড়িতে আর কেউ রাত কাটিয়েছেন?
-হ্যাঁ।
কারা তারা? আপনার আত্মীয়?
–না, একজন আমার স্ত্রীর বান্ধবী আর একজন মহিলা মাদ্রাজ থেকে এসেছিলেন।
–তাঁদের অভিজ্ঞতা কি?
-আমার স্ত্রীর বান্ধবী কিছু দেখেননি বা অনুভব করেননি। তবে মিস থাম্পি করেছিলেন।
বৃদ্ধের দু চোখ কুঁচকে উঠল। বললেন–তিনি কী অনুভব করেছিলেন?
–তার মতে ওবাড়িতে কিছু আছেই।
–কিছু না দেখেই বললেন?
উনি একজন থিওজফিস্ট। সারাজীবন প্রেততত্ত্ব নিয়ে চর্চা করেছেন।
বৃদ্ধ শিবানন্দ চুপ করে কী ভাবতে লাগলেন। তারপর বললেন, এবার আমি নিশ্চিত যে ঐ বাড়িতে যে আত্মাটি আছে তার লক্ষ্য একমাত্র আপনার স্ত্রী।
সঞ্জয় বলল, লক্ষ্য যে আমার স্ত্রী তা আমরাও বুঝেছি। কিন্তু কেন? সত্যিই কি ও বাড়িতে কোনোদিন তেমন কোনো ঘটনা ঘটেছিল যাতে আমার স্ত্রী কোনো আত্মার প্রতিহিংসার লক্ষ্য হয়ে দাঁড়িয়েছিল?
শিবানন্দ ভট্টাচার্য একটু চুপ করে রইলেন। তারপর চোখ বুজিয়ে বললেন, হ্যাঁ, ঘটেছিল। আর সে ঘটনার সঙ্গে আমারও কিছু যোগ ছিল। কেননা আমিও তখন থাকতাম গোলবাড়ির কাছেই। হাঁ, তা প্রায় ষাট বছর আগের কথা। ঘটনাস্থল ঐ গোলবাড়ি। সেসময়ে কলকাতায় এক বিখ্যাত যাদুকর ছিল।
যাদুকর! সঞ্জয় চমকে উঠল।
–হা হা, যাদুকর। আপনারা ইংরিজিতে যাকে বলেন–ম্যাজিসিয়ান।
লোকটা কি কালো কোট, কালো প্যান্ট, কালো টুপি পরত?
শিবানন্দ ধমকে উঠে বললেন, আপনারা যদি কথার মধ্যে কথা বলেন তা হলে আমি আর একটি কথাও বলব না।
ডাক্তার রুদ্র হাত জোড় করে বললেন, ক্ষমা করুন। আমরা অধৈর্য হয়ে পড়েছিলাম, কেননা ঘটনার শুরুতেই এমন অদ্ভুত মিল–
–আরো মিলবে। ধৈর্য ধরুন। বলে বৃদ্ধ কাশতে লাগলেন।
একটু সামলে নিয়ে বললেন, ম্যাজিসিয়ান কালো কোট, কালো প্যান্ট ছাড়া তো ধুতি পাঞ্জাবি পরবে না। কাজেই ওটা নতুন কিছু নয়। পরনে কালো পোশাক, স্টেজের পিছনে কঙ্কাল আঁকা কালো পর্দা, টেবিলের ওপর কালো রুমাল ঢাকা মড়ার মাথা, হাতে কালো একটা লাঠি-ম্যাজিসিয়ান সারা কলকাতায় ম্যাজিক দেখিয়ে দুহাতে পয়সা লুঠত। তার বেশির ভাগ দর্শক ছিল সাহেব-মেম। অবিনাশ বক্সীর খেলা হচ্ছে শুনলে সাহেব-পাড়া থেকে জুড়িগাড়ি ছুটিয়ে ওরা দলে দলে আসত।
কথার মাঝখানে এবার বাধা দিলেন নাতি ভদ্রলোক। তিনি হেসে বললেন, দাদু, রাগ কোরো না। মাঝে একটা কথা বলে নিই। বলেই ডাঃ রুদ্রর দিকে তাকালেন।
দাদু একটা কথা কিন্তু বাদ দিয়ে যাচ্ছেন। সাহেবরা যেমন অবিনাশ বক্সীর খেলা দেখতে ছুটত তেমনি দাদুর কাছে আসত হাত দেখাতে। দাদু তখন ছিলেন গোটা কলকাতা শহরের মধ্যে নামকরা জ্যোতিষী। শুধু হাতই দেখতেন না–লোকের কপালের দিকে তাকিয়েই তার ভবিষ্যৎ বলে দিতে পারতেন।
কিন্তু উনি তো শহরের পুরনো বাড়ির ইতিহাস সংগ্রহ করতেন বলেই জানি।
–হ্যাঁ, জ্যোতিষী ছিল তার জীবিকা আর ইতিহাস সংগ্রহ ছিল তার জীবন।
কি দাদু, তাই তো?
শিবানন্দ সংক্ষিপ্ত উত্তর দিলেন, তাঁ। তাই বটে।
একটু থেমে বললেন, কি জানেন, আপনারা গোলবাড়ির কথা জানতে এসেছেন, তার মধ্যে আমার কথা বলা নিষ্প্রয়োজন।
নাতি বললেন, কী যে বল! তোমাকে বাদ দিয়ে কি গোলবাড়ির কথা শেষ হয়? বিশেষ করে অবিনাশ বক্সীর ঘটনা? সে ঘটনা তো এর আগেও তুমি আমাদের বলেছিলে।
শিবানন্দ উদাসীনের মতো চুপ করে বসে পায়ের চেটোয় হাত বোলাতে লাগলেন।
ডাক্তার রুদ্র মিনতি করে বললেন, সব ব্যাপারটা একটু পরিষ্কার করে না বললে আমরা কিছুই বুঝতে পারছি না।
নাতি ভদ্রলোক এতক্ষণ দাঁড়িয়েছিল। এবার চৌকির ওপর এসে বসলেন। কিশোরীটি কিন্তু দাঁড়িয়েই রইল। সে মাঝে মাঝেই গোপনে তাকাচ্ছিল সঞ্জয়ের দিকে। চোখোঁচাখি হলেই চোখ নামিয়ে নিচ্ছিল।
ভদ্রলোক বললেন, দাদুই সব কথা শোনাবেন। আমি শুধু একদিনের কথা বলি। সেটা দাদুর নিজস্ব ব্যাপার বলে উনি হয়তো বলতে চাইবেন না।
এই বলে ভদ্রলোক একটু থামলেন। তারপর বলতে শুরু করলেন।
–অবিনাশ বক্সী ছিলেন ম্যাজিসিয়ান। আর দাদু ছিলেন জ্যোতিষী। না, অবিনাশ বক্সীর আরও একটা পরিচয়, তিনি জমিদারপুত্র। বর্ধমান জেলার কোনো গ্রামে তাদের জমিদারি ছিল। অবিনাশ বক্সী অবশ্য বেশির ভাগ সময়ই থাকত তাদের পূর্বপুরুষদের এই গোলবাড়িতে। কলকাতা তখন ধনীদের ফুর্তির আখড়া। এই সময়ে নিজেরই পরিবারের একটি কুমারী মেয়েকে নষ্ট করায় অবিনাশের বাবা ওকে ত্যাজ্যপুত্র করেন। চন্দননগরে একজন ফরাসী ম্যাজিসিয়ান বক্সীর বন্ধু ছিল। তার কাছ থেকে ম্যাজিক দেখানো শিখে বক্সী নিজেই একটা দল খুলে ফেলল। ম্যাজিক দেখানোই হল তখন তার জীবিকা।
যদিও এক পাড়াতে বাস, তবু দাদুর সঙ্গে বক্সীর কোনো সম্পর্ক ছিল না। না থাকারই কথা। কেননা বক্সী করত পাবলিক শো। আর দাদু ঘরে বসে লোকের হাত দেখতেন, কুষ্ঠী বিচার করতেন। কিন্তু দুজনেই দুজনের খ্যাতির কথা জানতেন। দাদুর খ্যাতিটা অবিনাশ যে বিশেষ পছন্দ করত না, তা অবশ্য দাদুর অজানা ছিল না। একদিনের একটা সামান্য ঘটনায় অবিনাশের ঈর্ষা যেন ফেটে পড়ল।