–তাতে আমাদের কিছু মনে হবে না। বয়োবৃদ্ধ মানুষ
–ঠিক আছে। একটু বসুন। ওঁকে খবর দিই। তারপর আপনাদের ওপরে নিয়ে যাব।
এই বলে ভদ্রলোক ভেতরে ঢুকছিলেন, ফিরে দাঁড়ালেন।
–আচ্ছা, কিরকম ইতিহাস জানতে চান? বাড়িটা কোন জায়গায়?
ডাক্তার রুদ্র বললেন, কালিন্দি-বরাটের কাছে। একটা পুরনো বাড়ি। Haunted house. বাড়িটার বিষয় উনি কিছু জানেন কিনা।
বুঝেছি। বলে ভদ্রলোক ভেতরে চলে গেলেন। একটু পরেই কাশির শব্দ পাওয়া গেল। মাঝে মাঝে কাশতে কাশতে কেউ নেমে আসছেন।
উনি বোধহয় নিজেই নেমে আসছেন। সঞ্জয় কান খাড়া করে রইল।
–বোধহয়। বলে ডাঃ রুদ্র উঠে দাঁড়ালেন।
মিনিট পাঁচ-সাতের মধ্যে আগের ভদ্রলোকটি একজন বৃদ্ধের হাত ধরে ঢুকলেন। পিছনে পিছনে এল একটি মেয়ে। বছর চোদ্দ বয়েস।
বৃদ্ধ এবার নিজেই চৌকির ওপর বসে তাকিয়াটা টেনে নিলেন। মেয়েটি দাঁড়িয়ে রইল ভদ্রলোকের পাশে।
বৃদ্ধের শরীর শীর্ণ। গাল ঢুকে গেছে। না-কামানো পাকা দাড়ি। কণ্ঠনালী ঠেলে বেরিয়ে এসেছে। গায়ে ফতুয়া। তার ওপর একটা চাদর। ছোটো ছোটো চোখ দুটো এ বয়েসেও কী তীক্ষ্ণ! চোখের দিকে তাকালে মনে হয় বয়েসকালে ভদ্রলোক বোধহয় অনেক নিষ্ঠুর কাজ করেছেন।
বৃদ্ধ একবার কাশলেন। তারপর বিনা ভূমিকায় বললেন, কপিল পাঠিয়েছে?
আজ্ঞে হ্যাঁ।
হঠাৎ?
বৃদ্ধ আবার কাশতে লাগলেন।
ডাঃ রুদ্র বললেন, তার আগে পরিচয় করিয়ে দিই। ইনি ডাঃ সঞ্জয় গুপ্ত। ডাক্তারি করা ছাড়াও পুরনো বাড়ির ইতিহাস সংগ্রহের বাতিক আছে।
বাতিক! বৃদ্ধ যেন আঘাত পেলেন। রূঢ়স্বরে বললেন বাতিক বলছেন কেন? ইতিহাস সংগ্রহ করা কি বাতুলের কাজ?
বৃদ্ধের নাতি এই সময়ে ইশারায় ডাঃ রুদ্রকে কিছু মনে না করতে অনুরোধ করলেন। বৃদ্ধ তখন বলে চলেছেন–আজকালকার ছেলেদের এই এক দোষ–কোনো সৎকাজকেও গুরুত্ব দেয় না।
তা কটা বাড়ির ইতিহাস পেয়েছেন? খাতাপত্র করেছেন?
ডাঃ রুদ্র পাচে পড়লেন।
সঞ্জয় সসংকোচে বলল, না, সেরকম কিছু করা হয়নি।
–তাহলে আর কি হল? শুধু লোকমুখে গল্প শোনা? না মশাই, ওতে কোনো কাজ হবে না। এসব ছেলেখেলা নয়। চলুন ওপরে। দেখাব আমি কিভাবে কাজ করেছি।
বৃদ্ধের নাতি তাড়াতাড়ি বললেন, দাদু, এঁরা বিশেষ একটা বাড়ি সম্বন্ধে জানতে চান। বলে তিনি সঞ্জয় আর রুদ্রের দিকে তাকালেন।
ডাঃ রুদ্র বললেন, ইনি কালিন্দির কাছে একটা বাড়িতে ভাড়া এসেছেন
শিবানন্দ ভুরু তুলে বললেন, কে ভাড়া এসেছেন?
ডাঃ গুপ্ত। বলে রুদ্র সঞ্জয়কে দেখিয়ে দিলেন।
কতদিন?
বছরখানেক হল। এখন অবশ্য ছেড়ে দিয়েছি।
—কেন?
–সেই কথাই বলতে এসেছি।
কতদিন ছেড়েছেন?
মাস তিনেক হল।
কতদিন ও বাড়িতে ছিলেন?
মাস নয়েক।
–আচ্ছা, তারপর বলুন।
সঞ্জয় তখন কলকাতায় বাসা নেওয়া থেকে শেষদিন পর্যন্ত সমস্ত ঘটনা বলে গেল।
বৃদ্ধের নাতি আর সম্ভবত নাতির মেয়েটি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সব শুনল।
শিবানন্দ কিছুক্ষণ চোখ বুজিয়ে রইলেন। তারপর বললেন—কালিন্দি-বরাট?
–আজ্ঞে হ্যাঁ।
–গোলবাড়ি চেনেন?
সঞ্জয় মাথা নাড়ল।–আজ্ঞে না।
–সে কী! কালিন্দি-বরাটে থাকেন গোলবাড়ি চেনেন না? গম্বুজওয়ালা পুরনো একটা বাড়ি। যুদ্ধের সময়ে আমেরিকান সোলজাররা থাকত। এখন কী অবস্থায় আছে জানি না।
সঞ্জয় বলল, গম্বুজওয়ালা বাড়ি! ঐ বাড়িটার কথাই তো বলছি।
–তাই বলুন।
বৃদ্ধ একটু থেমে কাশির দমক সামলে বললেন, তখন মানে, আমাদের ছোটোবেলায় ঐ বাড়িটাকে গোলবাড়ি বলত। একসময়ে জমিদারবাড়ি ছিল। তারপর এক নীলকর সাহেব ওটা দখল করে। কিন্তু সেও ভোগ করতে পারেনি।
এই পর্যন্ত বলে শিবানন্দ একটু থামলেন। তারপর বললেন, তা শেষ পর্যন্ত বাড়িটা ছাড়তেই হল?
আজ্ঞে হ্যাঁ। প্রথমে ছাড়তে চাইনি। কিন্তু সবই তো শুনলেন, না ছেড়ে উপায় ছিল না।
বৃদ্ধ কী ভেবে বললেন, আমি যার কথা ভাবছি তার আত্মার তাহলে আজও সদগতি হয়নি। কিন্তু
কথা আটকে গেল। বৃদ্ধ কাশতে লাগলেন। কাশি থামতে বললেন, একটা কথাই ভাবছি। সে তো মরেছে তা পঞ্চাশ-ষাট বছর হল। এত বছরের মধ্যে নিশ্চয় অনেক ভাড়াটে এসেছে। তাদের ওপর কি অত্যাচার হয়নি? বলে সঞ্জয়ের দিকে তাঁর সেই অদ্ভুত দৃষ্টি মেলে তাকালেন।
–ঠিক বলতে পারব না।
–পারব না, বললে তো হয় না। খোঁজখবর নিয়ে আসতে হয়। বৃদ্ধ বিরক্ত হয়ে অন্যদিকে মুখ ফেরালেন।
ধমকানি শুনে কিশোরীটি ফিক্ করে হাসল।
বৃদ্ধ একটু ভেবে বললেন, বোধহয় আর কেউ ভুক্তভোগী নয়। কেননা বিশেষ কোনো কারণ ছাড়া দুরাত্মারাও চট করে মানুষের পেছনে লাগে না। আত্মারও কষ্ট হয় জানবেন।
ডাঃ রুদ্র আর সঞ্জয় বৃদ্ধের দিকে তাকিয়ে রইলেন।
–আমার কথাটা বুঝতে পারলেন কি?
–আজ্ঞে হ্যাঁ। ডাঃ রুদ্র বললেন।
না, কিছুই বোঝেননি।
কিশোরীটি মুখ ঢাকা দিয়ে হাসতে লাগল।
–আমি মনে করি, বিশেষ কোনো কারণে কোনো দুষ্ট আত্মা বিশেষ কোনো একজনের ওপর প্রতিহিংসাপরায়ণ হয়ে ওঠে। এখন দেখতে হবে কার আত্মা, উদ্দেশ্যটাই বা কি?
বৃদ্ধর আবার কাশি উঠল। তিনি বুক চেপে ধরে জোরে জোরে কাশলেন। তারপর বললেন, আচ্ছা, আপনি কি সপরিবারে ওবাড়িতে থাকতেন? বৃদ্ধ ডাঃ রুদ্রের দিকে তাকলেন।
–আমি না, ইনিই সপরিবারে থাকতেন।
বৃদ্ধ তাঁর সেই অদ্ভুত দৃষ্টিতে এবার সঞ্জয়ের দিকে তাকালেন।