ডাক্তার রুদ্র বললেন, তোমার আর গিয়ে কাজ নেই।
দেওয়ালে ঝুলছিল ওদের একটা ছবি। ডাঃ রুদ্র যেন আজই প্রথম ওটা দেখলেন।
-ওটা কি তোমাদের বিয়ের ছবি?
সঞ্জয় হাসল। হ্যাঁ। এর আগে দেখেননি?
–হয়তো দেখেছি। খেয়াল হয়নি।
তিনি ছবিটার দিকে এগিয়ে গেলেন।
–তোমাদের একটা ছবি রাখতে ইচ্ছে করে।
সঞ্জয় রীণার দিকে তাকিয়ে বলল, বেশ তো নেবেন। আমাদের সম্প্রতি তোলা একটা
ডাক্তার রুদ্র বাধা দিয়ে বললেন, না না, সম্প্রতি নয়। পুরনো, যত পুরনো হয়। বিশেষ করে রীণারটা।
রীণা অবাক হল।
–পুরনো কেন?
ডাঃ রুদ্র হেসে বললেন, বুঝতে পারছ না কম বয়েসের ছবির আকর্ষণই আলাদা।
সঞ্জয় হো হো করে হেসে উঠল।
–আর এখন বুঝি বুড়ি হয়ে গেছি? রীণা মুখ লাল করে প্রতিবাদ করল।
ডাঃ রুদ্র তাড়াতাড়ি নিজের কথা শুধরে নিয়ে বললেন, না না, সেকথা বলিনি। আমি বলেছি আকর্যণ–attraction-এর কথা। আমার আজকের ছবির চেয়ে দশ বছর বয়েসের ছবি কি বেশি attractive নয়?
রীণা যেন কিছুটা আশ্বস্ত হয়ে বলল, কিন্তু সেরকম ছবি কি এখানে আছে? আপনি বরং আমাদের বিয়ের ছবিরই এক কপি নিয়ে যান। বলে উঠে ভেতরে চলে গেল।
.
০২.
একশো তিন বছরের সেই বৃদ্ধ
পলেস্তারা-ছাড়ানো দোতলা বাড়িটা। দোতলার জানলায় জানলায় বিবর্ণ পর্দা। পাঁচিলভাঙা ছাদে ফুলগাছের টব।
বেলা চারটে নাগাদ ডাঃ রুদ্র আর সঞ্জয় সেই বাড়ির দরজার সামনে এসে দাঁড়ালেন।
দরজা খোলাই ছিল। ডাঃ রুদ্র কয়েকবার কড়া নাড়লেন। কিন্তু কারো সাড়া পাওয়া গেল না।
হতাশ হয়ে সঞ্জয় বলল, শুধু শুধুই আসা হল।
–কেন?
–কারো তো সাড়া পাওয়া যাচ্ছে না।
–ভেতরে ঢুকে দেখা যাক। দরজা যখন খোলা তখন আশা করি অনধিকার-প্রবেশ ঘটবে না।
সঞ্জয়ের ঢোকার ইচ্ছে ছিল না। কিন্তু ডাঃ রুদ্র যখন ঢুকে পড়লেন তখন অগত্যা সঞ্জয়কেও ঢুকতে হল। ঘরে ঢুকতেই ধুলোর গন্ধ। সঞ্জয় তাড়াতাড়ি রুমাল বের করে নাকে চাপা দিল। বলল, ঘরে দেখছি ঝটও পড়ে না।
ঘরটা বেশ বড়ো। বৈঠকখানা ঘরের মতো। ঢুকতেই ডান দিকে একটা চৌকি। চৌকির ওপর শতছিন্ন শতরঞ্জি পাতা। শতরঞ্জির প্রায় সর্বত্র দোয়াত-ওল্টানো কালির দাগ। ময়লা ওয়াড়-জড়ানো একটা তাকিয়া দেওয়াল ঘেঁষে পড়ে আছে। ঘরের বাঁ দিকে পাশাপাশি তিনখানা বড়ো আলমারি। মান্ধাতার আমলের, বইতে ঠাসা। আলমারির বেশির ভাগ কাচই ভাঙা। তবে সবগুলোই তালা লাগানো। যদিও সে তালা বড়ো একটা ভোলা হয় না বলেই মনে হয়।
এবার? কারো নাম ধরে ডাকতে হয়। কিন্তু কার নাম ধরে ডাকবে? ভট্টাচার্যমশাই। আছেন? একশো তিন বছর বয়েসের বৃদ্ধকে হাঁক দিয়ে ডাকা শোভন নয়। বাবু বলেও সম্বোধন করা যায় না।
অস্বস্তির ব্যাপার আরো ছিল। কপিলেশ্বরবাবু বলে দিয়েছিলেন ভট্টাচার্যমশাইয়ের মেজাজ খারাপ। হয়তো দেখাই করবেন না। তখন যেন ছবিটা দেখানো হয়। ছবির নিচে প্রেরকের নাম দেখলেই তিনি খুশি হবেন। কিন্তু সে ছবি তো হারিয়ে গেল। তাহলে?
সঞ্জয়ের ইচ্ছে ছিল না। তবু চৌকির ওপর বসতে হল। আর একবার ঘরটা ভালো করে দেখল। দেওয়ালে তিনটে বড়ো বড়ো ছবি। বহু পুরনো। সম্ভবত শিবানন্দ ভট্টাচার্যের নিকট আত্মীয়দের। ফ্রেমের মধ্যে তিন জনেরই নাম আর জন্ম-মৃত্যুর সাল তারিখ লেখা আছে। কিন্তু অত উঁচুতে টাঙানো বলে পড়া গেল না।
ওদিকের দেওয়ালে ঝুলছে পুরনো কলকাতার একটা ম্যাপ। ডাঃ রুদ্র কৌতূহলী হয়ে এগিয়ে গেলেন। দেখলেন ম্যাপটি ১৭৯৪ সালে A. Upjohn-এর করা। এতে ১৭৪২ সালের আদি কলকাতা আর ১৭৫৬ সালের বৃহত্তর কলকাতার নকশা করা রয়েছে। এতে উত্তরে বাগবাজারের খাল থেকে দক্ষিণে Govermapur (গোবিন্দপুর) পর্যন্ত এবং পুবে মারাঠা ডিচ থেকে পশ্চিমে গঙ্গা পর্যন্ত অঞ্চলকে কলকাতা বলে দেখানো হয়েছে।
ডাঃ রুদ্র কৌতূহলী হয়ে দেখলেন ম্যাপে মাত্র একটি রাস্তারই নাম রয়েছে– Avenue leading to the Eastward। রাস্তাটি পশ্চিমে বর্তমান চিৎপুর রোড থেকে আরম্ভ করে পুব দিকে মারাঠা ডিচ পর্যন্ত চলে গেছে। এইটেই নাকি বর্তমানে বৌবাজার স্ট্রীট!
অন্যদিকে একটি তালিকা। কলকাতায় তখনকার দিনে পাকা বাড়ির সংখ্যা। যেমন–১৭০৬ খ্রীঃ–৮টি, ১৭২৬ খ্রঃ–৪০টি, ১৭৪২ খ্রীঃ–১২১টি, ১৭৫৬ খ্রীঃ–৪৯৮টি।
কাকে চাইছেন?
ভেতর থেকে গেঞ্জি গায়ে এক ভদ্রলোক বেরিয়ে এলেন। বছর পঞ্চাশ বয়েস। সৌম্যদর্শন। মাথার চুল ছোটো করে কাটা।
ডাক্তার রুদ্র নমস্কার করলেন।
–কিছু মনে করবেন না, সাড়া না পেয়ে ঢুকে পড়েছি।
ভদ্রলোক নরম সুরে বললেন, কোথা থেকে আসছেন?
কপিলেশ্বরবাবুর কাছ থেকে।
কপিলেশ্বরবাবু! ভদ্রলোক নামটা মনে করবার চেষ্টা করলেন।
ডাক্তার রুদ্র সঞ্জয়ের দিকে তাকালেন। সঞ্জয় তাড়াতাড়ি বলল, বাগুইহাটির কপিলেশ্বরবাবু।
-ও আচ্ছা! দাদামশাই! হ্যাঁ, বসুন। ঠাকুর্দার সঙ্গে দেখা করবেন বোধহয়?
–হুঁ, শিবানন্দ ভট্টাচার্যমশাই
ভদ্রলোক একটু কি ভাবলেন। তারপর বললেন–ঠাকুর্দার সঙ্গে কি দেখা করার একান্ত দরকার?
ডাক্তার রুদ্র বিনীতভাবে বললেন, একটা বিশেষ দরকারেই আসছি। একটা পুরনো বাড়ির ইতিহাস জানার জন্যে।
মনে হল ভদ্রলোক খুশি হলেন। বললেন, এ কথা শুনলে ঠাকুর্দা খুবই খুশি হবেন। উনি এখনো আমাদের ডেকে ডেকে পুরনো বাড়ির ইতিহাস শোনান। কিন্তু মুশকিল কি জানেন? ওঁর বয়েস একশো তিন। বেশি কথা বলা বারণ। তার পর একটুতেই চটে যান। হয়তো আপনাদের দুটো কথা শুনিয়ে দিতেও পারেন।