–এখনো রাগ পড়েনি?
–কিসের রাগ?
–ঐ যে তখন পাগল-টাগল বললাম কুমড়োর মতো মুখ।
রীণা দীর্ঘশ্বাস ফেলে পাশ ফিরে শুলো–নাগো, রাগের কথা নয়। তুমি আমার কথা বিশ্বাস করলে না। কিন্তু–আমি কী করে বোঝাব–
–তুমি কি সেই আবির্ভাবটিকে এখনো ভুলতে পারনি?
–কি করে ভুলব? প্রথমে ভেবেছিলাম আত্মীয়দের কেউ দেখা করতে এসেছে। একটু মজা করছে। কিন্তু দরজা খুলে যখন দেখলাম কেউ নেই তখন
বাধা দিয়ে সঞ্জয় বলল, আরে বাবা, নিশ্চয়ই কেউ ভুল করে তিনতলায় উঠে এসেছিল। তারপর নিজের ভুল বুঝে চুপি চুপি নিচে চলে গেছে। এই তো ব্যাপার। এই নিয়ে
রীণা এ উত্তরে নিশ্চিন্ত হল না। বলল, ব্যাপারটা অত সহজ নয়। লোকটা সিঁড়ি দিয়ে নামেনি। আমি এক মুহূর্তের জন্যে লোকটাকে জানলার সামনে দিয়ে বাঁ দিকে যেতে দেখেছি। আর ফিরতে দেখিনি। তুমি নিশ্চয় জান ওদিকটা একেবারে ব্লাইন্ড। ওদিক দিয়ে চলে যাবার উপায় নেই।
সঞ্জয় চুপ করে শুনল।
তাছাড়া আমি বন্দনাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম। ও সারা দুপুর সিঁড়ির সামনের ঘরে বসেছিল। কাউকে উঠতে দেখেনি বা জুতোর শব্দ পায়নি।
রীণার এত কথার পর সঞ্জয় শুধু একটা প্রশ্ন করল, বন্দনা আবার কে?
রীণা বিরক্ত হয়ে বলল, দোতলার নিখিলবাবুর মেয়ে বন্দনাকে চেন না? কত বার এসেছে। দেখেছ।
–আমি নিজের স্ত্রী ছাড়া অন্য মেয়ের দিকে তাকাই না।
–ওঃ! ভারি সাধু–পুরুষদের চিনতে আমার বাকি নেই।
বলে পাশ ফিরে শুলো।
ঘরের মধ্যে হালকা নীল আলো। মাথার ওপর পাখার ঝড়। বাইরে অন্ধকার আকাশে লক্ষ তারার চোখ-টেপা হাসি।
–ঘুমোলে? গাঢ়স্বরে সঞ্জয় জিজ্ঞেস করল।
–ঘুম আসছে না।
সঞ্জয় পাশ ফিরে ডান হাতটা ঝুলিয়ে দিল রীণার বুকের ওপর। একটু আকর্ষণ করল। রীণার হালকা দেহটা এসে পড়ল তার নিশ্বাসের মধ্যে।
–এবার ঘুমোও।
অমন করলে ঘুম হয়? বলে রীণা সঞ্জয়কে আঁকড়ে ধরল।
.
০৪.
রাত তখন গভীর
নতুন জায়গায় নতুন সংসারে রীণা কিছুটা খাপ খাইয়ে নিয়েছে। তবু বেলা তিনটে বাজলেই ও একটু উৎকর্ণ হয়ে থাকে। একদিন যে এসেছিল সে কি আবার কোনদিন আসবে? কিন্তু না, বেশ কিছুদিন তো হয়ে গেল আর কাউকে দেখা যায়নি, জুতোর শব্দটুকুও না।
রীণা এখন বেশ নিশ্চিন্ত। কিন্তু ভারি লজ্জা করে সেদিনের কথা ভাবতে। কী যে হয়েছিল–শুধু শুধু ভয় পেয়ে গেল। ছিঃ।
গত রবিবার প্রফেসার রুদ্র এসেছিলেন। ইনি ডাক্তারের হোটোকাকার বন্ধু। মেডিকেল কলেজে পড়ার সময়ে ওঁর কাছে ওকে প্রায়ই যেতে হতো। তাই সম্পর্কটা খুব ঘনিষ্ঠ।
প্রফেসার রুদ্র কলকাতার এক নম্বর ডাক্তারদের মধ্যে একজন। মানসিক রোগের চিকিৎসা করেন। কলকাতায় এসে পর্যন্ত ডাক্তার ওঁর সঙ্গে দেখা করার জন্যে ব্যস্ত হয়ে উঠেছিল। তারপর হঠাৎই গত রবিবার ও প্রফেসারকে নিয়ে এল।
বেশ ভালোই লাগছিল। এই প্রথম একজন চেনাশোনা বিশিষ্ট লোক তাদের বাড়িতে এল। কিন্তু ডাক্তার যখন খুব মজা করে সেদিনের ঘটনাটা প্রফেসার রুদ্রকে বলছিল রীণার তখন লজ্জায় মাথা কাটা যাচ্ছিল।
প্রফেসার অবশ্য কোনো ঠাট্টা করলেন না। হাসলেন একটু।
এখন তাই সেদিনের কথা মনে হলে রীণার ভারি অস্বস্তি হয়।
কিন্তু সেদিন যা দেখেছিল তা কি ভুল? চোখ কি এত বিশ্বাসঘাতকতা করে? হবেও বা। ইংরিজিতে ইলিউসান নামে যে একটা কথা আছে তা বোধহয় এইই।
.
সেদিন হাসপাতাল থেকে ফিরতে সঞ্জয়ের বেশ রাত হয়ে গেল।
ওরা বেশি রাত জাগে না। সাড়ে নটার মধ্যেই রাতের খাওয়া শেষ করে শুয়ে পড়ে। এদিন ওর ফিরতে রাত হওয়ায় রীণা ভয় পাচ্ছিল। হাসপাতাল থেকে ফিরতে সঞ্জয়ের প্রায়ই রাত হয়। কিন্তু কোনোদিন ভয়-টয় করত না। আজ হঠাৎই কেমন ভয় করল। সে কথাটা আর বলল না। খেয়েদেয়ে ওরা শুয়ে পড়ল। রীণা পুপুকে নিয়ে খাটে শোয়। ডাক্তার শোয় মেঝেতে।
অনেক রাত্রে হঠাৎ রীণার ঘুম ভেঙে গেল। কেন যে ঘুম ভাঙল রীণা ঠিক বুঝতে পারল না। শুনতে পেল যশোর রোড দিয়ে একটা মাতাল চেঁচাতে চেঁচাতে যাচ্ছে। মাতালটা বোধহয় রোজই এই সময়ে যায়। এর আগেও শুনেছে। উদ্দেশ্যহীনভাবে অশ্রাব্য গাল দিতে দিতে যায়। পরিচিত পরিবেশ। তবু কিরকম যেন গা-ছমছম্ করতে লাগল। মনে হল ঘরে বুঝি সে একা! সঞ্জয় বুঝি রুগী দেখে এখনও ফেরেনি। ঘোরটা কেটে যেতেই মনে পড়লনা, সঞ্জয় অনেকক্ষণ ফিরেছে। ঐ তো মেঝেতে শুয়ে আছে।
এমনি সময় পুপু হঠাৎ কেঁদে উঠল। ঠিক এইরকম ভাবেই কেঁদেছিল সেই সেদিন বেলা তিনটের সময়ে! কাঁদতে কাঁদতে পুপু ককিয়ে গেল। রীণা তাড়াতাড়ি পুপুকে কোলে তুলে নিয়ে টর্চ জ্বেলে বিছানা, বালিশের তলা দেখে নিল। না, কিছু নেই।
রীণা তখন পুপুকে বুকে চেপে ঘুম পাড়াবার চেষ্টা করল। পুপু ঘুমের মধ্যেও মাঝে মাঝে কাঁদছে। রীণা তখন ওকে শুইয়ে চাপড়াতে লাগল। তখনি হঠাৎ রীণার মনে হল কোথায় যেন কিসের শব্দ হচ্ছে। অস্পষ্ট শব্দ। মনে হল নিচের তলার কোনো ঘরে কেউ যেন দেওয়ালে পেরেক পুঁতছে।
হবেও বা। হয়তো মশারির দড়ি পেরেক উঠে এসেছে কারো ঘরে। তাই পেরেক ঠুকছে। রীণা পাশ ফিরে শুয়ে ঘুমোবার চেষ্টা করল। কিন্তু একটু পরেই আবার শব্দ–এবার সেই হালকা পেরেক পোঁতার শব্দটা ভারী হয়ে উঠছে। কেউ যেন কাঠের জুতো পরে একটা একটা পা ফেলে গুনে গুনে সিঁড়ি ভেঙে তেতলায় উঠে আসছে। রীণা কান খাড়া করে রইল। এত রাতে কে আসছে অমন করে?