রীণার বিছানার কাছে একটা চেয়ারে বসে সিগারেট খাচ্ছিল। ভাবনাটা এবার অন্যদিকে মোড় নিল। আজ রাত্তিরে যদি সত্যিই তেমন কিছু ঘটে তা হলে সাবধানতার জন্যে যা যা ব্যবস্থা ইতিমধ্যে করেছে তা যথেষ্ট কি না আর একবার যাচাই করে দেখতে চাইল।
নিজের ছোটো টর্চ ছাড়াও নতুন একটা বড়ো টর্চ কিনে রেখেছে। ছোটো বড়ো দুটো টর্চেই নতুন ব্যাটারি। রুগীর হার্ট ঠিক রাখার মতো প্রয়োজনীয় ওষুধ মজুত রেখেছে। ঘরে কুঁজো-ভর্তি খাবার জল, চা, কফি, দুধ, এক টিন বিস্কুট–তাছাড়া এক বোতল ব্রান্ডি-রাত জাগার জন্যে এসবেরই দরকার। সব কিছুরই ব্যবস্থা হয়ে আছে।
সারা রাত তাকে একাই জেগে থাকতে হবে। একবার ভেবেছিল বন্দনার মা-বাবাকে ডাকবে। কিন্তু ভেবে দেখল, কি জন্যে ডাকবে? তাঁদের তো বলা যাবে না যে, আজ রাত্রে অশরীরীটি হানা দেবে তার ঘরে।
একমাত্র রীণার কিছুটা বাড়াবাড়ি হওয়া ছাড়া আর যে কিছুই ঘটবে না সঞ্জয় সে সম্বন্ধে নিশ্চিত। কেন না সে জানে ঘরে লোক জেগে থাকলে তেমন-কিছু হয় না।
সঞ্জয় ঘড়ি দেখল। ছটা বাজে। পুপুকে ওষুধ খাওয়ালো। কেন কে জানে, ও আজ বড় ঘুমোচ্ছ। এবার রীণাকে দুধ খাওয়াতে হবে। ও তো কিছুই খেতে চাইছে না। শুধু চোখ বুজিয়ে পড়ে আছে। তবু গরম দুধ একটু না খাওয়ালেই নয়।
সঞ্জয় উঠে দুধ গরম করতে গেল।
একটু পরেই রীণার ক্ষীণ ব্যাকুল স্বর শোনা গেল।
–তুমি কোথায়?
–এই যে দুধ গরম করছি।
–শুনে যাও।
যাচ্ছি।
হিটার থেকে দুধের সসপ্যানটা নামিয়ে রেখে সঞ্জয় রীণার কাছে গেল। দেখল রীণা চারিদিকে তাকিয়ে কী যেন দেখছে।
-কি হল?
কিছু না। তুমি আমার কাছে বোসো।
–দুধটা আনি?
–পরে এনো। তুমি এখন বোসো।
–দুধ জুড়িয়ে যাবে। ফের গরম করতে হবে। বলে সঞ্জয় বসল।
দ্যাখো, আমি যেন কিছুই ভালো করে মনে করতে পারছি না। সব যেন কেমন ঘুলিয়ে যাচ্ছে।
–কিরকম? রীণার হাতটা সঞ্জয় তুলে নিল নিজের হাতে। একটু চমকালো। হাত দুটো ঠাণ্ডা।
–মনে হচ্ছে আমি যেন কত যুগ ধরে ঘুমোচ্ছি। কখনো মনে হচ্ছে আমি যেন আর এই পৃথিবীতে নেই। কত দূরে চলে গেছি। তারপরেই বুঝতে পারছি না, কোথাও তো যাইনি। এই তো আমার ঘর–এই তত আমার বিছানা–এই তো পুপু সোনা–পুপু কোথায়?
বন্দনা নিয়ে গেছে।
রীণা একটু থামল। তারপর চোখ দুটো বড় বড় করে তাকিয়ে ফিসফিস্ করে বলল, আচ্ছা, সেই লোকটা কি আর এসেছিল?
–কোন লোকটা?
–সেই যে ম্যাজিসিয়ানের মতো দেখতে। কালো প্যান্ট-কোট কালো টুপি
না তো, কোনো লোকই আসেনি। একটু হেসে আবার বলল, তাঁকে দেখার সৌভাগ্য তো আমাদের হয় না। উনি কেবল তোমাকেই দেখা দেন।
হ্যাঁ। আমাকেই যে তার দরকার। কি দরকার গো বলল না।
রীণা একদৃষ্টে তাকিয়ে রইল সঞ্জয়ের চোখের দিকে।
উঃ! কী সাংঘাতিক গেছে সেদিনের সেই বিকেলটা। আমি পুপুকে কোলে নিয়ে ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছি। হঠাৎ দেখি ঘরের মধ্যে কী যেন ঘুরছে তো ঘুরছেই। ধোঁওয়া–শুধু ধোঁওয়া….
বলতে বলতে রীণা হঠাৎ ছিটকে উঠে বসল। দ্রুত নিশ্বাসে তার বুক ওঠা-পড়া করতে লাগল। দুচোখে ভয়ের কালো ছায়া।
–কি হল? অমন করে উঠে বসলে কেন?
–আজ–আজ সেই শনিবার না?
শনিবার! না, না, শনিবার তো কাল গেছে। আজ রবিবার।
রীণা প্রবলভাবে মাথা নাড়ল। কক্ষণো না। আজই শনিবার।
সঞ্জয় হাসল–পাগল! শনিবার হলে আমি বাড়ি থাকি?
রীণার তবু যেন বিশ্বাস হল না। এদিক ওদিক তাকাল।
–এখানে যে ক্যালেন্ডারটা ছিল?
–পেরেকটা খসে গেছে। ওঘরে টাঙিয়ে রেখেছি।
রীণা আর বসে থাকতে পারল না। শুয়ে পড়ল।
কী জানি, আমার মনে হচ্ছে তুমি আমায় লুকোচ্ছ।
–শুধু শুধু লুকোব কেন?
–আর ভাবতে পারছি না। বলে পাশ ফিরে শুলো। একটু পরে পাশ ফিরেই বলল, সন্ধে হয়েছে?
না।
–তবু আলোটা জ্বেলে দাও। একটু অন্ধকার হলেই ভয় করে।
সঞ্জয় আলো জ্বেলে দিল। রীণার চোখদুটো হঠাৎ ঝকঝক করে উঠল।
–এবার তোমার দুধ গরম করে আনি?
–পুপু খেয়েছে?
–হুঁ। বন্দনাই দুধ খাইয়ে নিয়ে গেছে।
মনে হচ্ছে ছেলেটাকে যেন কত দিন দেখিনি। ওকে একবার নিয়ে এসো না।
-আগে তুমি দুধ খেয়ে নাও। তারপরে আনব।
সঞ্জয় উঠে দুধ আনতে যাচ্ছিল রীণা আবার ডাকল, তুমি বলছ আজ রবিবার?
–হ্যাঁ। কতবার বলব?
শনিবারের সেই ফাড়া তাহলে কেটে গেছে?
সঞ্জয় ধমক দিয়ে বলল–ফাড়া আবার কি? কিছুই হয়নি। সবই মনের ভুল।
রীণা হঠাৎ আবার উঠে বসার চেষ্টা করল।
–শোনো শোনো বলে দুহাত বাড়িয়ে সঞ্জয়ের হাত দুটো চেপে ধরল–আচ্ছা, মিস থাম্পি যেমন সেই প্রফেসারকে হিপনোটাইজ করেছিল তেমনি আমাকেও কেউ করছে না তো?
হিপনোটাইজ! শুধু শুধু তোমায় কেউ হিপনোটাইজ করবে কেন? তাছাড়া ওসব গালগল্প। বলে হাত ছাড়িয়ে নিয়ে দুধ আনতে গেল।
.
সন্ধের একটু পরে ডাঃ রুদ্র এলেন। মমম্ করে ঢুকলেন রীণার ঘরে।
-কেমন আছ?
–ভালো নয়। মোটেই ভালো নয়। তবু আপনাকে দেখলে যেন ভরসা পাই।
ডাক্তার রুদ্র একটা চেয়ার টেনে নিয়ে বসলেন। তারপর রীণার হাতটা টেনে নিলেন।
লেপের বাইরে হাত রেখে শুয়েছিলে বুঝি?
রীণা বলল, কী জানি। খেয়াল নেই।
ডাক্তার রুদ্র প্রেসার মাপতে লাগলেন। এক বার বার তিন বার। সঞ্জয় ঝুঁকে পড়ল।
-কত? রীণা জিজ্ঞেস করল।
—-ঠিক আছে।
রীণা সঞ্জয়কে বলল, ওঁকে কফি দাও।