এই চিঠির সঙ্গেই ছিল আলাদা আর একটুকরো কাগজ। তাতে লেখা ছিল–I love you dearly and want to have you as my life-partner by marriage….
ডাক্তার রুদ্র থামলেন। ঘড়িতে তখন নটা বেজে পনেরো মিনিট। ডাঃ রুদ্র উঠে পড়লেন।
তারপর থেকে মিস থাম্পি আর সম্মোহন করার চেষ্টা করেননি। ঐ লাইনটা ছেড়েই দিলেন। তিনি ঘুরতে লাগলেন দেশ-বিদেশ-পাহাড়-জঙ্গল-মঠ-মন্দির-গির্জা। যেখানেই প্রাচীন পুঁথি পান সেখানেই ছোটেন। বিশেষ কোনো মানুষকে চেয়েছিলেন বড় আপন করে। তা তিনি পাননি। তাই শেষ পর্যন্ত খুঁজে বেড়াতে লাগলেন অলৌকিক রহস্য- জীবন-মরণের সীমানা ছাড়িয়ে কোনো কিছু অদৃশ্য অস্তিত্বের সন্ধান।
.
ডাক্তার রুদ্রকে এগিয়ে দিতে যাচ্ছিল সঞ্জয়। ওরা যখন সিঁড়ির কাছে গিয়েছে তখন হঠাৎই রীণা ব্যস্ত হয়ে সঞ্জয়কে ডাকল, শুনে যাও।
ডাঃ রুদ্র থমকে দাঁড়িয়ে পড়লেন। সঞ্জয় ঘরে এসে ঢুকল।
–পুপুর চোখ দুটো দ্যাখো কিরকম বসে গেছে না?
সঞ্জয় টর্চ জ্বেলে ভালো করে দেখল। হ্যাঁ, চোখের নিচে কালি। চোখ দুটো হঠাৎ যেন বসে গেছে।
–কি হল? বলে ডাঃ রুদ্রও এসে দাঁড়ালেন। তিনিও দেখলেন। অনেকক্ষণ ধরেই দেখলেন।
রীণা জিজ্ঞেস করল, ওরকম হলো কেন?
ডাক্তার রুদ্র বললেন, ও কিছু নয়।
গাড়িতে ওঠার সময়ে ডাঃ রুদ্র জিজ্ঞেস করলেন, ওর কি পেটের অসুখ কিংবা বমি হয়েছিল?
সঞ্জয় বলল, বিকেলেও এরকম দেখিনি।
আচ্ছা, লক্ষ্য রেখো। আমায় জানিও। ডাক্তার রুদ্রের গাড়ি কম্পাউন্ড ছেড়ে বেরিয়ে গেল।
সঞ্জয় ওপরে উঠতে লাগল। তাকে কেমন চিন্তাচ্ছন্ন মনে হচ্ছিল। হঠাৎ চোখ বসে যাওয়াটা কেমন যেন অস্বাভাবিক।
.
১৭.
সংকেত
বৃহস্পতিবার। বেলা তখন তিনটে।
সঞ্জয় একটু আগে রাউন্ড দিয়ে নিজের চেম্বারে এসে বসেছে। হঠাৎ টেলিফোন। সঞ্জয় রিসিভারটা তুলে নিল।
হ্যালো!
ওপার থেকে ব্যাকুল কণ্ঠস্বর শোনা গেল–ডাঃ গুপ্ত? আমি বন্দনার মা–
কী ব্যাপার?
–আপনি শিগগির চলে আসুন। আপনার স্ত্রী হঠাৎ অজ্ঞান হয়ে গেছেন।
–এখনি যাচ্ছি। বলে ফোন রেখে সঞ্জয় বেরিয়ে পড়ল।
কম্পাউন্ডে ঢুকে ট্যাক্সি ছেড়ে দিয়ে সঞ্জয় প্রায় দৌড়ে তিনতলায় উঠল। দেখল বিছানায় শুয়ে আছে রীণা। মুখটা একেবারে সাদা। মাথার কাছে বসে আছেন বন্দনার মা। পুপুকে কোলে নিয়ে ঘুরছে বন্দনা।
রীণার জ্ঞান ফিরেছে। কিন্তু তাকাচ্ছে না। তাকাতে গেলেই কষ্ট হচ্ছে। সঞ্জয় কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে বসে রইল। একবার ডাঃ রুদ্রকে ফোন করার চেষ্টা করল। লাইন পেল না।
বিকেলের দিকে রীণা একটু একটু কথা বলল। কিন্তু কেন যে অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিলে তা বলতে পারল না।
–আজও কিছু দেখেছিলে নাকি?
রীণা অতিকষ্টে বলল, মনে নেই। ভাবতে গেলেই সব যেন কেমন গোলমাল হয়ে যাচ্ছে।
–আচ্ছা, তুমি ঘুমোও।
বলামাত্রই রীণা অতি ধীরে পাশ ফিরে শুলো।
সঞ্জয় আবার ডাক্তার রুদ্রকে ফোন করল। এবারে পেয়ে গেল। ডাঃ রুদ্র সব শুনলেন। একটি কথাও বললেন না। শুধু বললেন,যাচ্ছি।
সন্ধের সময়ে ডাঃ রুদ্র এলেন। রুগীকে দেখে মুখটা গম্ভীর হয়ে গেল। সঞ্জয়ের তা লক্ষ্য এড়ালো না। তবু জিগ্যেস করল, কিরকম বুঝছেন?
–বিশেষ ভালো না।
একটু থেমে বললেন, আমি তো তোমাকে বার বার বাসা বদলাতে বলেছি। এখনি বাসা না পাও, আমার বাড়িতে নিয়ে যেতে বলেছিলাম। তা তো শুনলে না। জেদ ধরে রইলে। মনে রেখো, আর একদিন পরেই সেই শনিবার।
নিরুপায় সঞ্জয় বলল, এখন যদি নিয়ে যাওয়া সম্ভব হয় তো
ডাঃ রুদ্র মাথা নাড়লেন–না, এ অবস্থায় ওকে আর নিয়ে যাওয়া যাবে না।
ডাঃ রুদ্রের একটা মিটিং ছিল। তাড়াতাড়ি উঠে পড়লেন। বলে গেলেন মিটিঙের পর আবার আসবেন। যাবার সময়ে জিজ্ঞেস করলেন, পুপু কেমন আছে?
সঞ্জয় অন্যমনস্কভাবে উত্তর দিল, ভালো।
–চোখ বসাটা?
পুপুকে নিয়ে বন্দনা বাইরে ঘুরছিল। সঞ্জয় ডাকল। বন্দনা পুপুকে নিয়ে এল। ডাঃ রুদ্র পুপুকে ভালো করে দেখলেন।
–চোখটা কিন্তু তেমনি বসে আছে। চোখের কোণে কালো দাগটা যেন আরো prominent হয়েছে। দেখেছ?
সঞ্জয় নির্লিপ্তভাবে উত্তর দিল, তাঁ। তবু ও ভালোই আছে। হাসছে খেলছে।
–কিন্তু চোখের নিচে কালিটা কিসের, ওটা এখনো আমরা ধরতে পারিনি। বলতে বলতে তিনি নেমে গেলেন।
.
১৮.
শেষ ছোবল
শনিবার।
সেই শনিবার। বিশ্বাস করুক না করুক, তবু একটা অজানা ভয়ে সকাল থেকেই সঞ্জয় যেন বিশেষ চিন্তিত। তার ওপর রীণার শরীর মোটেই ভালো নয়। বিছানা থেকে ওঠার শক্তিটুকুও নেই। কেন যে এমন হল সঞ্জয় কিছুতেই ভেবে পাচ্ছে না। তার ওপর কাল রাত্তির থেকে হঠাৎই পুপুর জ্বর হয়েছে। এবার শুধু চোখ নয়, বুড়োদের মতো গাল দুটোও বসে গেছে।
সঞ্জয় কদিন বেরোচ্ছে না। সকালেই একবার ডাঃ রুদ্রকে ফোন করেছিল। পায়নি। একটু আগে ফের ফোন করল। এবার পেল। ডাঃ রুদ্র বললেন, সন্ধের সময়ে যাচ্ছি। আর দ্যাখো, আজ যে শনিবার এটা রীণাকে জানিও না।
শেষ বিকেল।
পশ্চিমের জানলা দিয়ে একফালি রোদ দেওয়ালে এসে পড়েছে। কেমন যেন ফ্যাকাশে রোদ। এ যেন এক মন-খারাপ-করা বিকেল। এরকম সময়ে অন্যদিন সে বাড়ি থাকে না। তাই নির্জন ঘরে শীতের বিকেল যে এমন ভারাক্রান্ত হয় সঞ্জয় তা জানত না। এই-সব বিকেলে বেচারি রীণা কি করে যে একা থাকে তাই ভেবে সঞ্জয় আজ বিচলিত হল।