ডাক্তার তো বলে দিলেন বেড়ালে ভেঙেছে। কিন্তু আমার খটকা যায়নি।–তা তো বটেই। অবশ্য আর কী-বা হতে পারে? চোর-ডাকাত হলে ধরা পড়ে যেত।
যাই হোক ব্যাপারটা রহস্যজনক।
রহস্যজনক বলে রহস্যজনক। পুরনো বাড়ি। কী দোষ আছে কে জানে!
–তুমি থামো বিভূতিবাবু! সন্ধেবেলা আর ভয় ঢুকিয়ে দিয়ো না। মনে রেখো আমরাও এক বাড়িতে থাকি।
-কিন্তু একটা মীমাংসা হওয়ার তো দরকার।
–কিসের মীমাংসা?
—বাড়িতে যদি কোনো দোষ থাকে–
–দোষ থাকলেই কি আমরা বাড়ি ছাড়তে পারব?
সবাই একটু থমমত খেয়ে শচীনবাবুর দিকে তাকিয়ে রইলেন।
শচীনবাবু কাগজটা ভাঁজ করতে করতে বললেন, আমি তো পারব না। এত কম ভাড়ায়, সেলামী ছাড়া আর কোথায় বাড়ি পাব?
যুক্তি অকাট্য। সত্যিই তো। যতই ভূতের উপদ্রব হোক এ বাড়ি ছাড়া যাবে না। ভূতের হাত থেকে মুক্তি পাওয়া যায়, কিন্তু একটা বাড়ি ছেড়ে দিলে বাড়ি পাওয়া দায়।
শাস্তি-স্বস্ত্যয়ন তো করা যায়।
–তা যায়। তবে তার আগে আসল ব্যাপারটা জানা দরকার।
–তাহলে ডাক্তারকে জিজ্ঞেস করতে হয়।
—ডাক্তার কিছু বলবে মনে করেছ? দেখছ না লোকটা কারো সঙ্গে মেশে না।
তা হোক, তবু একবার সবাই মিলে–ঐ তো ডাক্তার ফিরছেন। চলোচলো-খুব উৎসাহে বিভূতিবাবু সবাইকে বললেন বটে কিন্তু আর নাড়তে চাইলেন না। শেষ পর্যন্ত শচীনবাবু একাই এগিয়ে গেলেন।
-নমস্কার, ডাক্তারবাবু।
নমস্কার, ভালো আছেন?
–এই চলছে আর কি! আপনার কথাই এতক্ষণ আমরা আলোচনা করছিলাম। আপনার স্ত্রী এখন কেমন আছেন?
–ভালোই আছেন। কেন বলুন তো?
–যাক। নিশ্চিন্ত হলাম। সেদিন যা দুর্ঘটনা ঘটতে যাচ্ছিল–খুব সময়ে আপনি এসে পড়েছিলেন। তারপরই উনি আবার অজ্ঞান হয়ে গেলেন।
হ্যাঁ, নার্ভাস ব্রেকডাউন। সঞ্জয় সংক্ষেপ করতে চাইল।
ইতিমধ্যে সকলেই এসে দাঁড়িয়েছেন সঞ্জয়কে ঘিরে। মহিমাবাবু বললেন, এমনি-এমনি কি নার্ভাস ব্রেকডাউন হয় ডাক্তারবাবু? নিশ্চয়ই কোনো কিছুতে ভয় পেয়েছিলেন।
ভয়! না না, ভয় কিসের? কলকাতার মতো জায়গায় আমরা সকলে মিলে মিশে রয়েছি–একবার চেঁচিয়ে উঠলে পাঁচজনে ছুটে আসবে। এখানে চোর-ডাকাতের সাধ্য কি ঢোকে। না-না, কোনো ভয় নেই। নিশ্চিন্তে থাকুন। বলতে বলতে সঞ্জয় সিঁড়ির দিকে এগিয়ে গেল।
মহিমাবাবুরা কিছুক্ষণ সেদিকে তাকিয়ে থেকে বললেন, দেখলেন তো। আমাদের কিছু বলতেও দিলে না।
ও দিকে সিঁড়ি দিয়ে উঠতে উঠতে বিরক্ত সঞ্জয় মনে মনে বলল, এদের জন্যেই দেখছি বাড়িটা ছাড়তে হবে। প্রেস্টিজ বলে কিছু আর রইল না।
.
১৬.
মিস থাম্পির জীবনকথা
পুপুর জ্বর ছেড়ে গেছে–খবরটা ডাক্তার রুদ্র আগেই ফোনে পেয়েছেন। তবু এদিন সন্ধ্যায় এলেন। এসে রীণাকে জিজ্ঞেস করলেন, কেমন আছ?
রীণা ম্লান হেসে বলল, ভালো। কি খাবেন বলুন, চা না কফি?
কফিই করো।
রীণা রান্নাঘরে ঢুকল।
ঘরে ছিলেন বন্দনার মা। রীণা অসুস্থ হবার পর থেকে উনি প্রায়ই আসেন। তিনিও উঠে রীণার সঙ্গে রান্নাঘরে গেলেন। রীণা এখন বেশ সুস্থ। তবু তার চোখের চাউনিতে একটা উদভ্রান্তভাব। ডাঃ রুদ্রের তা লক্ষ্য এড়ায়নি।
বন্দনার মা রীণাকে বললেন, আপনি গল্প করুন, আমি কফি করছি।
কলকাতায় মান্তু ছাড়া রীণা এই একজন মানুষকে কাছে পেয়েছে। বাড়ির অন্য ভাড়াটেদের স্ত্রীরা কিন্তু ভিন্ন প্রকৃতির। কারো পরের সংসারের ওপর মাত্রাতিরিক্ত কৌতূহল, কেউ-বা ঈর্ষাকাতর। বন্দনার মা-ই ব্যতিক্রম। অল্প কথা বলেন, রীণার ওপর তাঁর যেন সত্যিকারের মেহ, রীণাও যেন একজন দিদি পেয়েছে।
কফির পেয়ালার চুমুক দিয়ে ডাক্তার রুদ্র বললেন, তোমরা তো মিস থাম্পিকে দেখলে। আমার দুর্ভাগ্য তাঁকে দেখতে পেলাম না। খবর পেলে নিম্ম আসতাম। বলে সঞ্জয়ের দিকে তাকালেন।
সঞ্জয় অপরাধীর মতো বলল, আপনি যে ওঁর সম্বন্ধে এত ইন্টারেস্টেড কি করে জানব বলুন। জানলে নিশ্চয় খবর দিতাম।
–আবার যদি কখনো আসেন তাহলে খবর দিতে ভুল না। ইংরিজি একটা ম্যাগাজিনে ওঁর লাইফহিস্ট্রি পড়ে অবাক হয়েছিলাম। ওঁর মতো spiritualist এখন সারা ভারতে নেই। অথচ মজার কথা প্রথম জীবনে উনি ছিলেন নামকরা সম্মোহনবিদ। ওঁর জীবনটাই ইনটারেস্টিং। সম্মোহনবিদ থাকার সময়ে তরুণী বয়েসে তিনি একবার তার সেই শক্তির অপব্যাবহার করেছিলেন। অবশ্যই তার একটা কারণ ছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত ওঁর অনুশোচনা হয়। অনুশোচনা থেকেই আসে পরিবর্তন। তিনি হিপনোটিজ ছেড়ে দেন। শুরু হয় জীবনের আর এক নতুন অধ্যায় স্পিরিচুয়ালিজমের সাধনা।
ডাঃ রুদ্র একটু থামলেন। তারপর বললেন, সঞ্জয় তুমি তো জান মেসমেরিজম্ নিয়ে আমিও কিছু পড়াশোনা করছি। কাজেই ও সম্বন্ধে আমি যদি কিছু বলি তাহলে নিশ্চয় অনধিকারচর্চা হবে না।
বলে তিনি একটু হাসলেন।
রীণা জিজ্ঞেস করল, কাকাবাবু, হিপনোটিজম্ আর মেসূমেরিজম্ কি এক?
বন্দনার মা চলে যাচ্ছিলেন, রীণা তার হাত ধরে বলল, বসুন না।
বন্দনার মা বসলেন।
ডাঃ রুদ্র বললেন, হ্যাঁ, একই। বাংলায় এর নাম সম্মোহন।
সঞ্জয় বলল, তা হলে ম্যাজিসিয়ানরা যে হিপনোটিজমের খেলা দেখায় সেও কি এই সম্মোহন?
ডাক্তার রুদ্র বললেন, কতকটা। তবে প্রকৃত সম্মোহনবিদরা কিন্তু একটু তাকিয়েই অপরকে সম্মোহিত করতে পারেন। এমন কি গল্প করতে করতেও এ বিদ্যা প্রয়োগ করতে পারেন। এমনও দেখা গেছে, এক জন পাকা সম্মোহনবিদ অনেক দূরের কোনো মানুষকে সম্মোহিত করেছেন। আমাদের দেশের কাঁপালিক বা ডাইনিরা কতকটা এই জাতীয় একটি বিদ্যায় পটু ছিলেন। তাকে বলে বশীকরণ। মানুষ বশ করতে ওস্তাদ ছিলেন তাঁরা। তবে তার জন্যে যে সাধনার প্রয়োজন তা অনেকের পক্ষেই করা সম্ভব হতো না। অল্পস্বল্প যেটুকু শক্তি তারা অর্জন করতেন তার বেশির ভাগটাই প্রয়োগ করতেন ব্যক্তিগত স্বার্থে। এখন তাদের কথা থাক। আমার বক্তব্য মেসমেরিজ।