সঞ্জয় ছেলেমানুষের মতো জেদ ধরে বলল, শনিবার পর্যন্ত তো আমি থাকবই।
ডাঃ রুদ্রের মুখটা কঠিন হয়ে উঠল। তিনি বললেন, তুমি থাকতে চাও থাকো। আমি ওদের নিয়ে যাব।
সঞ্জয় বলল, না। তা হয় না কাকাবাবু। রীণা না থাকলে তিনি তো আসবেন। ঐ শনিবার আমি সারা দিন রীণাকে পাহারা দেব। দেখব কি করে ওর ক্ষতি করে?
–তাহলে যা ভালো বোঝ করো। এরপর আমার আর কিছু বলার নেই।
তিনি উঠে রীণাকে পরীক্ষা করতে গেলেন। মিনিট পাঁচেক পরে ঘর থেকে বেরিয়ে এলেন।–ভালোই আছে। ওর যদি ঘুম ভাঙে তাহলে রাতের খাবার খাবে। ঘুম যেন ভাঙিও না।
বলে বেরোতে যাচ্ছেন এমনি সময়ে বন্দনার মা পুপুকে কোলে নিয়ে চিন্তিত মুখে ঢুকলেন।–পুপুর জ্বর হয়েছে দেখছি।
–জ্বর! সঞ্জয় চমকে উঠে পুপুর কপালে হাত দিল।বেশ জ্বর। বলে ডাঃ রুদ্রের দিকে তাকালো। ডাঃ রুদ্র পালস্ দেখলেন। কিছু বললেন না।
সঞ্জয় চিন্তিতভাবে তাকালো, কি করব?
ডাঃ রুদ্র হাসলেন, তুমি নিজে ডাক্তার। ছেলের একটু জ্বর হয়েছে। তাতেই ঘাবড়ে যাচ্ছ? বলে সঞ্জয়ের কাঁধে হাত রাখলেন।
–আজকের রাতটা দ্যাখো। কাল জ্বর না ছাড়লে ভাবা যাবে।
ডাঃ রুদ্র ঘর থেকে বেরিয়ে এলেন। সঞ্জয় বন্দনার মাকে বলল, আপনি একটু থাকুন। আমি এঁকে এগিয়ে দিয়ে আসছি।
বন্দনার মা বললেন, আমি থাকছি। আপনি একটু বন্দনাকেও পাঠিয়ে দেবেন।
ডাঃ রুদ্র গাড়িতে উঠে ইঞ্জিনের চাবি ঘোরালেন।কাল সকালেই তাহলে একটা খবর দেবে। কী এত ভাবছ?
–হ্যাঁ, নিশ্চয় খবর দেব। ভাবছিলাম–আপনিও বাড়ি ছাড়ার কথা বললেন, আর একজনও বলছিলেন।
–কে তিনি?
সঞ্জয় ইতস্তত করে বলল, আপনাকে বলা হয়নি গত সপ্তাহে মিস থাম্পি নামে একজন ম্যাড্রাসি মহিলা আমার এখানে এসেছিলেন রীণার এক বান্ধবীর সঙ্গে। রীণার কথা সব শুনলেন। তিনিও বলছিলেন–
ডাঃ রুদ্র গাড়ির চাবি বন্ধ করে বিস্ময়ের সঙ্গে বললেন, ব্যাঙ্গালোরের বিখ্যাত স্পিরিচুয়ালিস্ট মিস থাম্পি নাকি?
–হ্যাঁ। আপনি চেনেন?
ডাঃ রুদ্র চাবি ঘুরিয়ে ফের ইঞ্জিন চালু করে বললেন, ওঁর সঙ্গে দেখা হলে খুশি হতাম। নেক্সট ডে যখন আসব ওঁর কথা বলব। গুড নাইট।
১.৪ কাটা ঘায়ে নুনের ছিটে
শীতের বিকেল।
কম্পাউন্ডের মধ্যে লাঠি হাতে বার পাঁচেক পাক দিয়ে অমৃতবাবু বেঞ্চিতে এসে বসলেন।
ওপাশে আপাদমস্তক চাদর মুড়ি দিয়ে বেঞ্চির ওপর পা তুলে বসেছিলেন বিভূতিবাবু। পাশে মহিমাবাবু। গায়ে পুরনো একটা অলেস্টার। মাথায় মাংকি-ক্যাপ।
অমৃতবাবু জিজ্ঞেস করলেন, আচ্ছা, পৌষ সংক্রান্তিটা কবে?
ওদিকের বেঞ্চিতে শচীনবাবু বিকেলের ম্লান আলোতেও কাগজ পড়বার চেষ্টা করছিলেন। বয়েস এঁদের চেয়ে কিছু কম। রসিকতা করে তিনি বললেন, পৌষ সংক্রান্তিটা পৌষ মাসের শেষ দিন।
–আহা তা তো জানি। ইংরিজির কত তারিখ?
এবার আর শচীনবাবু উত্তর দিতে পারলেন না।
তা সংক্রান্তির খোঁজ কেন? পিঠে খেতে ইচ্ছে করছে নাকি? অমৃতবাবুর দিকে মন্তব্য ছুঁড়ে দিয়ে মহিমাবাবু হা-হা করে হাসলেন।
-হ্যাঁ, কত দিন যে পিঠে খাইনি!
—তা গিন্নিকে বলবেন। পিঠে ভেজে দেবেন।
–তা হলেই হয়েছে। ওসব পাট বহুকাল চুকে গিয়েছে। বৌমাও পিঠে করতে জানেন না।
–যা বলেছেন। বিভূতিবাবু নড়ে চড়ে বসলেন।
–এমন শীতে বেগুন পোড়া কঁচা লংকা দিয়ে খাব তার উপায় নেই। বৌমাকে বললাম, তো উনি বললেন, গ্যাসের উনুনে বেগুন পোড়াব কি করে?
শচীনবাবু বললেন, আমি তো এই জন্যেই গ্যাসের উনুন নিইনি।
বিভূতিবাবু বললেন, বেগুন পোড়ানো যাবে না বলেই গ্যাস-উনুন নেননি।
-না, ঠিক তা নয়। তবে অন্যতম কারণ বটে।
–তা বাকি কারণগুলি কি? অ্যাকসিডেন্ট?
–নিশ্চয়। প্রায়ই তো শুনি গ্যাস লিক করে আগুন ধরে গেছে।
–তা কয়লার উনুনে কি অ্যাকসিডেন্ট হয় না? এখন কি-সব শাড়ি উঠেছে–সিন্থেটিক না কি ছাইভস্মতা সেই সিন্থেটিক শাড়ির আঁচলটি একবার উনুনে পড়লেই
অমৃতবাবু হাসলেন। ঠিক বলেছেন। একবার আঁচল ধরলেই আর দেখতে হবে না। সঙ্গে সঙ্গে বধূহত্যার দায়ে বাড়িসুদ্ধ সকলের কোমরে দড়ি। তা পুত্রবধূই হন আর নিজের বৃদ্ধা বধূই হন।
–তা বটে। কোনটে যে অ্যাকসিডেন্ট আর কোনটে যে আত্মহত্যার প্ররোচনা, কে বিচার করবে? বাড়ির বৌ মরল তো ধর ছেলেকে আর ছেলের বাপকে।
অ্যাকসিডেন্ট কি শুধু আগুনে পুড়েই হয়? এ বাড়িতেই সেদিন কী কাণ্ডটা হতে যাচ্ছিল ভাবুন তো। সে তো আমরা চোখের সামনেই দেখলাম।
–হ্যাঁ। ভাগ্যি ঠিক সময়ে ডাক্তারবাবু এসে পড়েছিলেন?
–কিন্তু ছেলেকে নিয়ে ঝাঁপ?
–অশান্তিটা বোধহয় খুবই গুরুতর। নিচুগলায় বললেন বিভূতিবাবু।
–একে ডাক্তার তার ওপর যোয়ান বয়েস। আবার হাসপাতালে নার্সদের নিয়ে কাজ-করবার…!
-কিন্তু উনি কি সত্যিই আত্মহত্যা করতে যাচ্ছিলেন?
তাছাড়া কি?
তাছাড়াও ব্যাপার আছে মশাই, ব্যাপার আছে। আমার ওয়াইফ তো সঙ্গে সঙ্গে ওপরে গিয়েছিলেন। নিজে কানে শুনেছেন কিছু-একটা দেখে ভয় পেয়ে নাকি ঝাঁপ দিতে গিয়েছিল।
মহিমাবাবুর কথায় হঠাৎ যেন সবাই থমকে গেলেন। অমৃতবাবু আরও কাছে সরে এসে বললেন, তাঁ, ব্যাপার যে কিছু আছে সে বিষয়ে আমারও সন্দেহ নেই। মনে আছে মাস দেড়েক আগে অনেক রাত্তিরে ওপরের ঘরে চেঁচামেচি?
–হ্যাঁ, গেলাস ভাঙার শব্দ?