সঞ্জয়ের মুখে তবু হাসি ফুটল না।
–কেন যে বার বার এমন হচ্ছে বুঝতে পারছি না।
–তোমার স্ত্রী তো আগে এমন ভয় পেত না?
–কোনোদিন তো শুনিনি।
ডাক্তার রুদ্র চুপ করে রইলেন। একটু পরে বললেন, বাড়িটা না হয় ছেড়েই দাও।
সঞ্জয়ের ভুরুতে অসহিষ্ণুতার চিহ্ন ফুটে উঠল–আপনিও একথা বলছেন। শেষে ভূতের ভয়ে বাড়ি ছাড়ব!
ডাঃ রুদ্র একটু হাসলেন। বললেন, তোমার কথা আমি বুঝতে পারছি। ভূত না অলৌকিক কিছু, নাকি মানসিক ব্যাধি, এসব তর্কে আজ আর যেতে চাই না। এখানে থাকলে যদি ওঁর ক্ষতি হয় তাহলে এখান থেকে যাওয়াটাই যুক্তিসঙ্গত নয় কি?
কিন্তু সেদিন তো আপনিও বললেন, ও সাইকোপ্যাথিক পেশেন্ট?
ডাঃ রুদ্র একটা চুরুট ধরালেন। তারপর ধীরে ধীরে বললেন, এসব ক্ষেত্রে সিদ্ধান্ত বলে কিছু নেই। আজ লক্ষণ শুনে যা মনে হবে, কাল রুগীকে দেখে অন্যরকম মনে হতে পারে।
সঞ্জয় অসহিষ্ণু ভাবে বলল, তাহলে কি মানতে হবে এ বাড়িতে আসার পরই কোনো একটি অশরীরী আত্মা কেবলমাত্র রীণার ক্ষতি করতে চাইছে। সে রীণাকে তার সঙ্গে যেতে বাধ্য করবে। But how is it possible and why? একটা অশরীরী আত্মা একটা জীবন্ত মানুষকে….
বাধা দিয়ে ডাঃ রুদ্র বললেন, না, জীবন্ত মানুষকে সে চায় না।
তার মানে ওকে মেরে ফেলবে?
–হয় তো তাই। তার সূচনাও তো আজ কিছুক্ষণ আগে দেখতে পেলে।
সঞ্জয় চুপ করে কি যেন ভাবতে লাগল।
ডাঃ রুদ্র বললেন, তুমি কি মনে কর রীণা আত্মহত্যাই করতে যাচ্ছিল?
না, কখনোই না।
ডাঃ রুদ্র একটু ভেবে বললেন, আমারও তাই মনে হয়। ওর মতো সুখী মেয়ে সুইসাইড করতে যাবে কেন?
সঞ্জয় বলল, তবে ফ্রাস্টেশানে ভুগতে ভুগতে নিজেকে অসহায় বলে মনে হলে মানুষ বাধ্য হয়ে আত্মহত্যা করে শাস্তি পেতে চায়।
ফ্রাস্টেশান বলছ কেন?
–ঐ যে ওর কথা আমরা কেউ বিশ্বাস করছি না। তাছাড়া পুপুকে নিয়ে রেলিং থেকে ঝুঁকে পড়াটা আত্মহত্যার চেষ্টাই বোঝায়।
ডাঃ রুদ্র মনোযোগ দিয়ে শুনলেন। তারপর অল্প হেসে বললেন, কিন্তু আমি প্রমাণ পেয়েছি ও আত্মহত্যা করতে যায়নি।
অবাক চোখে সঞ্জয় ডাক্তার রুদ্রর দিকে তাকালো।
–হুঁ, অকাট্য প্রমাণ পেয়েছি। মনে আছে, রীণাকে যখন উঠে দাঁড়াতে বলেছিলাম তখন ও ভয় পেয়ে বলেছিল পড়ে যাব। যে উঠে দাঁড়াতে গিয়ে পড়ে যাবার ভয় পায় সে কি দেড়ঘন্টা আগে স্বেচ্ছায় তিন তলা থেকে ঝাঁপ দেবার চেষ্টা করতে পারে?
সঞ্জয় থমথমে মুখে ডাঃ রুদ্রের দিকে তাকিয়েই রইল। কোনো উত্তর দিতে পারল না।
ডাঃ রুদ্র বলতে লাগলেন–এই থেকেই প্রমাণ হয় রীণা যা বলেছে তা সত্যি। ভয়ংকর কিছু দেখেছিল যার জন্যে বারান্দার শেষ প্রান্তে গিয়ে অমন সাংঘাতিকভাবে ঝুঁকে পড়ে তার হাত থেকে নিজেকে সরিয়ে নেবার এমন শেষ চেষ্টা করছিল।
সঞ্জয় একটু ভেবে বলল, আচ্ছা, রীণা কি হিস্টিরিয়ায় ভুগছে? হিস্টিরিয়ার রুগীকে লোকে ভূতে-পাওয়া বলে। এইসব রুগীদের শক্তি নাকি এতদূর হয় যে জলভর্তি ঘড়া দাঁতে করে তুলে উঠোনের এপ্রান্ত থেকে ওপ্রান্ত পর্যন্ত নিয়ে যেতে পারে। কাজেই হিস্টিরিয়াগ্রস্ত হলে…
ডাঃ রুদ্র বাধা দিয়ে বললেন, তুমি বলতে চাইছ রীণা হিস্টিরিয়ার পেশেন্ট। আচ্ছা, তোমার স্ত্রী তো সারাদিন দরজা বন্ধ করেই থাকে, তাই না? তাহলে আজ হিস্টিরিয়ার প্রকোপ যখন তার বাড়ল, তখন বুঝি সে তোমার আসার জন্যে দরজা খুলে রেখে ঝাঁপ দিতে গেল?
সঞ্জয় চুপ করে রইল।
দরজাটা তা হলে খুলল কে?
সঞ্জয় তখনও নিরুত্তর।
নিভে-যাওয়া চুরুটটা আবার দুটো কাঠি ধ্বংস করে ধরালেন ডাঃ রুদ্র। বললেন, উত্তরটা আমিই দিচ্ছি। দরজা খুলেছিল সে, যে একদিন রাত্রে ঐ টেবিলের কাছে ঘুরতে ঘুরতে কাচের গ্লাসটা ভেঙেছিল, যে কুলুঙ্গি থেকে শিবানন্দ ভট্টাচার্যের ছবিখানা চুরি করেছিল। সে-ই রীণাকে ওয়ার্নিং দিয়ে দরজা খুলে রেখে গেল।
একটু থেমে বললেন, অবশ্য তুমি জিজ্ঞেস করতে পার–অশরীরী আত্মাকেও কি দরজা খুলে যেতে-আসতে হয়? তাহলে অবশ্যই আমি চুপ করেই থাকব। কেননা তার উত্তর জ্ঞানের বাইরে।
সঞ্জয় মন দিয়ে সব শুনল। কোনো উত্তর দিল না।
কয়েক মিনিট দুজনেই চুপচাপ বসে রইলেন। পাশের ঘরে রীণা নিশ্চিন্তে ঘুমোচ্ছ। বাইরের দরজা ঠেলে ঘরে ঢুকলেন বন্দনার মা ট্রেতে দুকাপ চা আর কিছু নোনতা বিস্কুট নিয়ে।
সঞ্জয় একটা কাপ এগিয়ে দিল ডাঃ রুদ্রর দিকে। নিজে নিল অন্যটা। বিস্কুটে কামড় দিয়ে সঞ্জয় বলল, কিন্তু শিবানন্দের ছবি চুরি করার উদ্দেশ্য?
আত্মাটির ক্রিয়াকলাপ দেখে মনে হচ্ছে তোমার এই প্রশ্নের উত্তর সোজা। তুমি বলেছিলে ছবির পিছনে ঠিকানা লেখা ছিল। স্পিরিট চায় না শিবানন্দর সঙ্গে তোমার যোগাযোগ হয়। তাই সে ছবিটা সরিয়ে ফেলেছে।
সঞ্জয় চায়ের পেয়ালায় চুমুক দিয়ে বলল, তবে তো শিবানন্দর কাছে আমায় যেতেই হবে। অশরীরী আত্মাটি অনেক কিছুই জানেন, জানেন না যে, ছবি নিয়ে গেলেও ঠিকানাটি আমার মুখস্থ হয়ে আছে।
ডাঃ রুদ্র পেয়ালা নামিয়ে রেখে বললেন, তবে আর কি? একদিন চলে যাও ওঁর কাছে। তবে তার আগে কিন্তু বাড়িটা ছাড়বে।
–এত তাড়াতাড়ি বাড়ি পাব কোথায়?
–এখনি বাড়ি না পাও আমার ওখানে উঠবে। মোট কথা সামনের শনিবারের আগেই তোমরা এ বাড়ি ছাড়বে।