রীণা বুঝি মুহূর্তের জন্যে থমকে গেল। নিচে যারা ছিল সঞ্জয়ের চিৎকারে তারাও ওপর দিকে তাকালো। সঙ্গে সঙ্গে সকলেই চেঁচিয়ে উঠল–গেল–গেল–গেল!
সঞ্জয় ছুটল সিঁড়ির দিকে। তিনতলায় উঠতে তিন মিনিটও লাগল না। সিঁড়ির মুখে এসে থমকে দাঁড়াল। ঘরের দরজা খোলা কেন? এমন তো কোনোদিন থাকে না।
কিন্তু সেদিকে মন দেবার সময় নেই। দৌড়ে গেল ব্যালকনির দিকে। জাপটে ধরল রীণাকে–এ কি করছিলে?
পুপুকে বুকের মধ্যে দু হাতে আঁকড়ে ধরে সেখানেই বসে পড়ল রীণা। কোনোরকমে বলল, এসেছ?
–হ্যাঁ, লোডশেডিং-এ ভয় পাবে বলে ট্যাক্সি নিয়ে চলে এলাম।
–সেটা কোথায় গেল?
–কে? কার কথা বলছ?
রীণা আর কথা বলতে পারল না। তার অচৈতন্য দেহটা মাটিতে লুটিয়ে পড়ল। চেঁচামেচি শুনে বন্দনার মাও উঠে এসেছিলেন। তিনি তাড়াতাড়ি পুপুকে কোলে তুলে নিলেন।
আর চাপাচাপি রইল না কিছুই। সঞ্জয়ের পিছু পিছু সকলেই ওপরে উঠে এসেছে। ঘরভর্তি লোক। অজ্ঞান হয়ে মাটিতে পড়ে আছে রীণা। সঞ্জয় ওর জ্ঞান ফেরাবার চেষ্টা করছে। সকলের মুখেই চাপা প্রশ্ন–কি হল? সুইসাইড করতে যাচ্ছিলেন নাকি? কিন্তু খামোক আত্মহত্যা করতেই-বা যাবে কেন? দুটি মানুষের সংসার। অশান্তি তো কিছু নেই।
প্রায় পনেরো মিনিট পরে রীণা ধীরে ধীরে চোখ মেলে তাকালো। কিন্তু সে দৃষ্টি বড়ো স্তিমিত।
-কেমন আছ? সঞ্জয় ঝুঁকে পড়ল রীণার মুখের ওপরে। কি হয়েছিল?
ঘরসুদ্ধ সবাই রীণার দিকে তাকিয়ে।
রীণ কোনো উত্তর দিতে পারল না। কেমন একরকম শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল।
সঞ্জয় কিছুক্ষণ রীণাকে লক্ষ্য করল। তারপর পাল্স দেখতে লাগল। এক বার-দুবার-তিন বার। শেযে ঘড়ির কাটার সঙ্গে পা-বিট মেলাতে লাগল। ওর মুখ গম্ভীর হয়ে উঠল।
একজন জিজ্ঞেস করলেন, কেমন দেখলেন?
–ভালো না। বলেই সঞ্জয় উঠে পড়ল।
বন্দনার মা দূরে দাঁড়িয়ে পুপুকে ভোলাচ্ছিলেন। সঞ্জয় বলল, বৌদি, আপনি এখানে একটু থাকুন। আমি আপনার ঘর থেকে একটা ফোন করে আসি।
সঞ্জয়ের উদ্বেগ দেখে এবার ভিড় কমতে লাগল। সঞ্জয় নিচে নামতেই দেখল বন্দনা মুখ শুকনো করে দাঁড়িয়ে।
-কাকীমা?
–ভালো নয়। এখুনি আমায় একটা ফোন করতে হবে।
ভাগ্য ভালো। মিনিট পাঁচেকের মধ্যেই লাইন পাওয়া গেল। শুধু লাইন নয়, ডাক্তার রুদ্রকেও।
সংক্ষেপে সব ব্যাপার জানিয়ে সঞ্জয় বলল, কাকাবাবু, আপনি এখুনি চলে আসুন। আমি একা ভরসা পাচ্ছি না।
.
আধ ঘণ্টার মধ্যেই ডাঃ রুদ্র এসে পড়লেন। রীণা তখনো মাটিতে চোখ বুজে পড়ে আছে।
ডাক্তার রুদ্র নাড়ী দেখলেন, প্রেসার চেক করলেন। চোখের পাতা ফাঁক করে টর্চ ফেললেন। তারপর সঞ্জয়কে জিজ্ঞেস করলেন ব্রান্ডি আছে?
সঞ্জয় মাথা নাড়ল।
–গরম দুধ?
বন্দনার মা বললেন, আমি এনে দিচ্ছি। বলে তিনি পুপুকে নিয়ে দোতলায় চলে গেলেন।
ডাঃ রুদ্র ব্যালকনিতে গিয়ে দাঁড়ালেন।
–তুমি বলছ রীণা এখান থেকে ঝাঁপ দিতে যাচ্ছিল?
–হ্যাঁ। তখন লোডশেডিং–আবছা অন্ধকার, তবু আমি স্পষ্ট দেখেছি।
–কি দেখেছ?
–রীণা পুপুকে এক হাতে বুকে চেপে ধরে রেলিং-এর ওপর উঠছে।
–তুমি ঠিক জান ঝাঁপ দিতেই যাচ্ছিল? ঝুঁকে কিছু দেখছিল না?
–হ্যাঁ, ঠিক জানি। শুধু আমি কেন নিচে যাঁরা বসেছিলেন তারা সবাই গেল গেল বলে চেঁচিয়ে উঠেছিল।
–তারপর?
তারপর আমি তাড়াতাড়ি ওপরে উঠে এলাম।
–ঘরে ঢুকলে?
–হ্যাঁ।
দরজা বন্ধ ছিল না?
না। এটাই আশ্চর্য লাগল।
–কেন?
রীণা কখনো দরজা খুলে রাখে না।
–হুঁ, তারপর?
–আমি ছুটে ব্যালকনিতে গেলাম।
–কি অবস্থায় দেখলে?
–ও তখন রেলিং ধরে কাঁপছিল। আমি ওকে ধরলাম।
ডাঃ রুদ্র আরও কয়েক মিনিট ব্যালকনিতে রইলেন। তারপর বললেন, ঘরে এসো।
এরই মধ্যে বন্দনার মা গরম দুধ নিয়ে এসেছেন। সঞ্জয় বাটিটা হাতে করে রীণার কাছে গিয়ে বসল।
–দেখি, দুধটা খেয়ে নাও।
ডাঃ রুদ্র বললেন, উঠে বোসো।
রীণা মাথা নাড়ল।
ডাঃ রুদ্র বললেন, ঠিক পারবে। উঠে বোসো।
রীণা দুহাতে ভর দিয়ে কোনোরকমে উঠে বসল।
ডাঃ রুদ্র বললেন, তুমি নিজে হাতে বাটিটা ধরো।
রীণার হাত কাঁপছিল তবু কোনোরকমে বাটিটা ধরল।
–খাও।
বীণা বলল, খেতে ইচ্ছে করছে না।
–তবুও খেতে হবে।
রীণা ধীরে ধীরে বাটিতে চুমুক দিল।
খাওয়া হলে বাটিটা মাটিতে রাখল।
ডাক্তার রুদ্র বললেন, এবার উঠে দাঁড়াতে হবে।
রীণা করুণ চোখে সঞ্জয়ের দিকে তাকাল।
একটু চেঁচিয়ে ডাঃ রুদ্র বললেন, ওঘরে গিয়ে বিছানার শুতে হবে তো।
রীণা বলল, পড়ে যাব।
পড়ে যাব সামান্য দুটি কথা। কিন্তু ঐ কথা দুটিতেই ডাঃ রুদ্রের দু চোখ ঝকঝক করে উঠল। যেন সঞ্জয়কে লক্ষ্য করেই নিচুগলায় বললেন–তাহলে দ্যাখো, পেশেন্ট পড়ে যেতে ভয় পায়। তারপর রীণাকে বললেন, না, পড়বে না। চেষ্টা করো। ওঠো বলছি।
–সঞ্জয়, help her বলে ডাঃ রুদ্র নিজেই রীণার পিছনে এসে দাঁড়ালেন। সঞ্জয়ের কাঁধে ভর দিয়ে রীণা গিয়ে বিছানায় শুয়ে পড়ল।
দশ মিনিট পর ডাক্তার রুদ্র সঞ্জয়কে একটা ইনজেকশান দিতে বললেন। ইনজেকশান ডাক্তার রুদ্রর কাছেই ছিল। সঞ্জয় ইনজেকশান দিল।
ডাঃ রুদ্র বললেন, এসো। বাইরের ঘরে ঘণ্টাখানেক বসা যাক। ও এখন ঘুমোক।
দুজনে বাইরের ঘরে এসে বসলেন।
–কি রকম বুঝলেন?
না, সিরিয়স কিছু নয়। হঠাৎ ভয় পেয়েছে। ইনজেকশান দেওয়া হল, ঠিক হয়ে যাবে।