–তাহলে, আপনি বলছেন রীণা যা দেখে তা ঠিক?
–হ্যাঁ। অবশ্যই।
—প্রকিার?
–আমার মনে হয় বাড়িটা ছেড়ে দেওয়াই ভালো।
সঞ্জয় মাথা নেড়ে বলল, কিন্তু সে কি করে সম্ভব? আমি নিজে ডাক্তার। বৈজ্ঞানিক প্রমাণ ছাড়া অশরীরী আত্মার অস্তিত্ব মানতে পারি না।
মিস থাম্পি তার বিশেষ হাসিটি একটু হাসলেন। কিছু বললেন না।
আধ ঘণ্টার মধ্যেই মান্তু আর মিস থাম্পি প্রস্তুত হয়ে নিল। যাবার সময়ে মিস থাম্পি বললেন, ডাঃ গুপ্ত, আপনার সংস্কারমুক্ত মন আর সাহসের প্রশংসা করি। কিন্তু আমার একটা কথা মনে রাখবেন–যদি দেখেন আপনার ছেলেটি ক্রমশই অসুস্থ হয়ে পড়ছে তা হলে তদ্দণ্ডেই বাড়ি ছেড়ে দেবেন। লে হাতে ব্যাগটা তুলে নিয়ে নিচে নামতে লাগলেন।
রীণা বিহ্বল দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল।
.
১৪.
সঞ্জয়ের চ্যালেঞ্জ
কদিন হল মিস থাম্পি চলে গিয়েছেন। মান্তুর সঙ্গেও যোগাযোগ নেই। রীণার মনটা তাই একটু খারাপ ছিল। দুঃসময়ে নিজের লোক ছাড়াও প্রকৃত বন্ধুর সান্নিধ্য যে কত দরকার হয় মান্তুকে পেয়ে রীণা তা বুঝতে পেরেছে।
বেলা তখন চারটে। পুপুটা কদিন ধরে ঘ্যানঘ্যান করছে। শীতটাও বেশ জোরে পড়েছে। বিকেলবেলায় কখনো কখনো পুপুকে নিয়ে রীণা নিচে কম্পাউন্ডে নেমে আসে। কম্পাউন্ডে বেশি ভিড় থাকলে নিচে নামে না। সংকোচ হয়। তার যেন মনে হয় সবাই তাকে একরকমভাবে দেখছে। তাই নিজেকে মনে হয় যেন তাদের কাছে অতিপ্রাকৃত জগতের কেউ। তাই সে অনেক সময়ে পুপুকে নিয়ে তিনতলার ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে থাকে।
এদিনও দাঁড়িয়ে ছিল। মিনিট দশেক হল লোডশেডিং শুরু হয়েছে। এই এক অসহ্য ব্যাপার। রীণার কাছে আবার শুধুই অসহ্য ব্যাপার নয়, ভীতির কারণ।
নিচে ছেলেরা খেলা করছে, বৃদ্ধরা বেঞ্চিতে বসে নিশ্চিন্ত মনে সম্ভবত সাংসারিক বিষয় নিয়ে গল্প করছে। বন্দনার মা কোথায় বেরিয়েছিলেন, কিছু জিনিস কিনে রিকশা থেকে নামলেন।
আচ্ছা, মিস থাম্পি যে এসে এক রাত এখানে কাটিয়ে গেলেন বন্দনা বা বন্দনার মা কি তা জানেন?
জানলেও এঁদের সেরকম গায়ে-পড়া কৌতূহল নেই। এটা অবশ্য ভালোই।
বড়ো অদ্ভুত মহিলা মিস থাম্পি। প্রথম যেদিন রীণা ওঁকে দেখে সেদিন ভালো লাগেনি। কিন্তু এ বাড়িতে তাঁকে খুবই ভালো লাগল।
মিস থাম্পি এ বাড়ি সম্বন্ধে কি যেন বললেন? ছেড়ে দেওয়াটাই উচিত। একদিক দিয়ে সে খুশি। আর যাই হোক তার মানসিক রোগ হয়নি। এত দিন তাহলে যা দেখেছে, যা বলেছে সব সত্যি। সঞ্জয় কি এবার তা বুঝতে পেরেছে? তাহলে কি আর একদিনও এ বাড়িতে থাকা উচিত? মিস থাম্পির কথায়–evil spint আছে যে দুরাত্মা হিংস্রকুটিল। শাসিয়ে যায়।
রীণার গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠল। ঠিক তখনই হঠাৎ পুপু কেঁদে উঠল আবার।
রীণা ভোলাতে লাগল, না না, কান্না কেন বাবুসোনা? ওই দ্যাখো ছেলেরা কেমন বল খেলছে। তুমিও বড়ো হয়ে বল খেলবে। তোমার বাপী তোমায় বল কিনে দেবে–সুন্দর লাল বল–
পুপুর কান্না তবু থামল না। দ্বিগুণ জোরে কাঁদতে লাগল।
রীণা মনে মনে সঞ্জয়ের জন্যে ব্যস্ত হচ্ছিল। সন্ধ্যের সময়ে লোডশেডিং হলে কিছুতেই একলা থাকতে ভালো লাগে না।
কিন্তু পুপু ডুকরে ডুকরে কাঁদছে কেন? বেঁকে বেঁকে যাচ্ছে। এ কান্নাটা যেন…।
রীণার বুক কাঁপতে শুরু করল। তাহলে কি এই সন্ধেবেলাতেই….
তখনই রীণার মনে হল ঘরের মধ্যে যেন কিসের চাপা শব্দ! তারপরই হঠাৎ একটা দমকা হাওয়ায় ঘরের জানলাগুলো সশব্দে খুলে গেল।
ঘরের দিকে তাকাতেই রীণার মেরুদণ্ডের মধ্যে দিয়ে একটা হিমস্রোত বয়ে গেল। দেখল ঘরের মধ্যে একটা ধোঁয়ার কুণ্ডলি মেঝে থেকে ক্রমাগত ওপরে উঠছে! মনে হচ্ছে নিচের তলায় যেন আগুন লেগেছে। মেঝে খুঁড়ে তারই ধোঁয়া সমস্ত ঘরটাকে গ্রাস করে ফেলছে। ধোঁয়াটা কিসের বুঝতে বুঝতেই ধোঁয়ার মধ্যে থেকে ফুটে বেরোল একটা মূর্তি। সে মূর্তি ওর চেনা। সেই কালো প্যান্ট, কোট আর টুপি। টুপিটা নেমে এসেছে আধখানা কপাল পর্যন্ত। তারপরেই মূর্তিটা দুরন্ত গতিতে ঘুরপাক খেতে লাগল।
রীণা ভয়ে কাঠ হয়ে সেই দিকে তাকিয়ে রইল।
ক্রমে মূর্তির চোখে মুখে একটা হিংস্রভাব ফুটে উঠল। রীণা স্পষ্ট বুঝতে পারল মূর্তিটা দাঁতে দাঁত চেপে কি যেন বলছে!
রীণার শুনতে ইচ্ছে করছিল না। তার এত ভয় করছিল যে সে থরথর করে কাঁপছিল। তবু ইচ্ছার বিরুদ্ধেই শোনার জন্যে কান পাততে হল। কেউ যেন হুকুম করছে–আমি যা বলি শোনো!
একটা চাপা হিসহিস্ শব্দের ভেতর দিয়ে ছেঁড়া ছেঁড়া কয়েকটা কথা বেরিয়ে এল–আগামী শনিবার…রাত দুটো…আমি আসব। তুমি যাবে…নইলে…বলেই মূর্তিটার মর্চে-ধরা লোহার শাবলের মতো দুখানা অদ্ভুত সরু সরু হাত এগিয়ে আসতে লাগল পুপুর দিকে!
পুপু তখন নেতিয়ে পড়েছে রীণার কাঁধে। মুখ দিয়ে লালা ঝরছে। কদবার শক্তিও বুঝি আর নেই।
পালাবার উপায় নেই। সামনেই মূর্তিটা দাঁড়িয়ে। রীণা ব্যালকনির ওপর ঝুঁকে পড়ল। দেখল নিচে ছেলেরা তখনো খেলা করছে, বয়স্করা গল্প করছে।
রীণা চিৎকার করে ডাকতে চাইল, কিন্তু গলা থেকে স্বর বেরোল না।
এদিকে অন্ধকার ঘরের মধ্যে থেকে সেই অদ্ভুত বিকৃত দুখানা হাত ধীরে ধীরে এগিয়ে আসছে। হাতের চেটো দুটো অস্বাভাবিক হোট!
ঠিক সেই সময়ে একটা ট্যাক্সি এসে ঢুকল কম্পাউন্ডের মধ্যে। সঞ্জয় নামল ট্যাক্সি থেকে। ভাড়া চুকিয়ে ওপর দিকে তাকালো। লোডশেডিং। তিনতলাটা অস্পষ্ট। তবুও যা দেখতে পেল তাতেই সঞ্জয় চমকে উঠল। পুপুকে কোলে নিয়ে রীণা যেন ব্যালকনি থেকে ঝাঁপ দেবার চেষ্টা করছে! আতঙ্কে চেঁচিয়ে উঠল সঞ্জয়। রীণা! পড়ে যাবে–পড়ে যাবে