মান্তু বলল, দুটো আলাদা ব্যাপার না? একটা বীভৎস জিনিস সহ্য করতে না পারা। আর একটা কুসংস্কার না মানা। দুটোয় গুলিয়ে ফেললে কি করে হবে?
–কি জানি। তোমার বান্ধবীর মনস্তত্ত্ব বুঝি না। আমার মনে হয় স্রেফ মানসিক ব্যাধি।
বেশ! মানসিক ব্যাধি হলেও তো তার প্রতিকার করতে হবে।
–স্বামী যখন ডাক্তার তখন ব্যবস্থা তিনিই করছেন।
–ছাই করছে। শুধু ঠাট্টা আর বিদ্রূপ।
ললিতবাবু আলিস্যি ভেঙে উঠে পড়লেন, যাই একটু ঘুরে আসি।
ওমা! যাবে কী! এখুনি রীণা এসে পড়বে।
ললিতবাবু উঠছিলেন, বসে পড়লেন। টাইমটেবলটা আবার তুলে নিয়ে নাড়াচাড়া করতে লাগলেন। একসময়ে বললেন, এবার আমরা রাজস্থানের দিকে যাব। কি বলো?
মান্তু বললে, তার তো এখনো ঢের দেরি। পরে ভাবলেও চলবে। বলে আবার জানলার কাছে গিয়ে দাঁড়াল। নিজের মনেই বলল, সাড়ে পাঁচটা বাজতে চলল। এখনো এল না!
এমন সময়ে পিওন এসে লেটার-বক্সে চিঠি ফেলে গেল।
মান্তু তাড়াতাড়ি বেরিয়ে গিয়ে লেটার-বক্স খুলে চিঠিটা বের করে নিয়ে এল। খামে চিঠি। অপরিচিত হাতে ইংরিজিতে ঠিকানা লেখা।
কার চিঠি?
মান্তু খামটা ললিতবাবুর হাতে দিয়ে পাশে বসল।
চিঠি পড়ে ললিতবাবু নড়েচড়ে বসলেন। খুশি-খুশি গলায় বললেন, মিস থাম্পিকে মনে আছে?
-খুব আছে। কেন?
–তিনি কলকাতায় আসছেন।
–ওমা! কবে?
পড়ে দেখো।
মান্তু চিঠিটা নিয়ে এক নিশ্বাসে পড়ে ফেলল। মিস থাম্পি লিখছেন, আগামী ২৭ নভেম্বর ম্যাড্রাস মেলে কলকাতা পৌঁছচ্ছেন। সেখান থেকে সোজা ললিতবাবুর বাড়ি চলে আসবেন। দু-তিন-দিন থাকবেন। কলকাতায় থিওফিক্যাল সোসাইটি এবং আরও কয়েকটি জায়গায় ঘুরবেন। সেসময়ে এদের সাহায্য দরকার হবে। কেন-না কলকাতার রাস্তাঘাট তাঁর ভালো জানা নেই।
মান্তু আনন্দে লাফিয়ে উঠল–মিস থাম্পি তাহলে কথা রেখেছেন।
তারপর ক্যালেন্ডারের দিকে তাকিয়ে বলল, ২৭শে নভেম্বর মানে সামনের বুধবারের পরের বুধবার। ওদিন তোমার কোথাও বেরোনো হবে না।
ললিতবাবু হেসে বললেন, বেরোতে হবে না মানে? বেরোতে আমায় হবেই, অন্তত হাওড়া স্টেশনে ওঁকে রিসিভ করতে।
মান্তু রসিকতাটা বুঝল। এরপর দুজনেই কিছুক্ষণ চুপচাপ। দুজনেই মিস থাম্পির কথা ভাবছিলেন। অনেক কথাই মনে পড়ছিল।
দুবছর আগে তিরুপতির পাহাড়ে এই মহিলার দর্শন পান ওঁরা।
তিরুপতি পাহাড়টা ছিল বেশ উঁচু। দীর্ঘ পিচঢালা বাস-রাস্তাটা ওপরে উঠে গেছে পাহাড়টাকে ঘিরে ঘিরে–মেয়েরা যেমন পাক দিয়ে শাড়ি পরে তেমনিভাবে। রাস্তার দুধারে পাহাড়ে ঝোপ-জঙ্গল। সে-সব জঙ্গলে কেউ বোধহয় কোনদিন যায় না। যাবার দরকারও হয় না।
কিন্তু পাহাড়ের ওপর উঠে মান্তুরা অবাক হয়ে গিয়েছিল। একেবারে শহর! ঝকঝকে তকতকে রাস্তা। দু পাশে হালফ্যাশানের বাড়ি, বাজার, দোকান। এমনকি বিখ্যাত একটি ব্যাঙ্ক পর্যন্ত।
দু-একদিন আগে কী একটা বিশেষ উৎসব হয়ে গিয়েছে বলে তিরুপতির মন্দিরে তেমন ভিড় ছিল না। তাই তিরুপতি দর্শন হয়ে গেল বেলা তিনটের মধ্যেই। পাহাড় থেকে নামার লাস্ট বাস পাঁচটায়। পঁয়তাল্লিশ মিনিট লাগে নিচে নামতে। সেখানে দাঁড়িয়ে আছে মান্তুদের বাস। সেটা ছাড়বে সন্ধে ছটায়। কাজেই হাতে যথেষ্ট সময়।
মান্তুদের সঙ্গে আরো যারা ছিলেন তাঁরা পাহাড়ের ওপরে কেনাকাটা করতে লাগলেন। মান্তুরা সামান্য কিছু কিনে জায়গাটা ঘুরতে বেরোল। ললিতবাবুর কি খেয়াল হল টাউন ছেড়ে নেমে এলেন পাহাড়ের ধারে। বললেন, লোকে তো এদিকে বড়ো একটা আসে না, চলো আমরা ওদিকটা দেখে আসি।
একটু নেমেই ওঁদের নজরে পড়ল একটা ছোটোখাটো আশ্রম।
এখানে আবার আশ্রম কিসের!
কৌতূহলী হয়ে ওঁরা একটু এগোতেই যে দৃশ্য চোখে পড়ল তাতে ওঁরা ভয় পেয়ে গেলেন। দেখলেন আশ্রমের পিছনে একটা গাছের ডালে অনেকগুলো মড়ার মাথার খুলি ঝুলছে। খুলিগুলো নানা আকারের। সবচেয়ে ছোটোটা হাতের মুঠোয় ধরা যায়। আর সবচেয়ে বড়োটা যে মানুষের মাথা তা ভাবা যায় না।
এঁরা যখন অবাক হয়ে খুলিগুলো দেখছেন তখনই একজন মহিলা আশ্রম-কুটির থেকে বেরিয়ে এলেন। তাঁকে দেখে মান্তু আঁতকে উঠেছিল। কালো লম্বা চেহারা। একটা দাঁত ঠোঁট থেকে সামান্য একটু বেরিয়ে। পুরু ঠোঁট। ঘাড় পর্যন্ত ছাঁটা এক মাথা পাকা চুল। পরনে গেরুয়া লুঙ্গি, গায়ে কালো সোয়েটার। গলায় লাল পাথরের মালা। মোটামোটা আঙুলে দামী পাথর। সবচেয়ে যেটা নজর কাড়ে তা হচ্ছে তার ঝকঝকে চোখ দুটো।
মিস থাম্পি ওদের সাদর অভ্যর্থনা করলেন। এইভাবেই আলাপ হল।
ভদ্রমহিলা ইংরিজিতেই কথা বললেন। জানা গেল, উনি সেখানে আছেন চল্লিশ বছর। একাই থাকেন।
কী করেন জিজ্ঞাসা করলে প্রথমে একটু হেসেছিলেন মাত্র। শেষে তিনি যা বললেন তার অর্থ হলো প্রেতচচা!
শুনে তো মান্তুর বাকরোধ হবার যোগাড়। সে থিওজফিস্টদের কথা শুনেছে বটে কিন্তু কখনো থিওজফিস্ট চোখে দেখেনি। তারা কোথায় থাকে, কীভাবে থাকে, বা তাদের চর্চার বিষয় ঠিক কি জিনিস, সে সম্বন্ধে তার কোনো স্পষ্ট ধারণাই ছিল না। এই প্রথম একজন থিওজফিস্ট-এর সঙ্গে আলাপ হলো।
দেখতে যেমনই হোক, ক্রিয়াকলাপ যাই হোক, মানুষটি ভাল। খুবই অতিথিপরায়ণ। তিনি তাঁদের সাদরে ঘরের মধ্যে নিয়ে গিয়ে আসন পেতে বসালেন। কফি খাওয়ালেন। মান্তুর ইচ্ছে ছিল প্রেতচর্চার ব্যাপারটা একটু শোনে। কিন্তু সাহস করে জিজ্ঞেস করতে পারল না। ললিতবাবুও অবশ্য দেরি হয়ে যাচ্ছে বলে কেবলই উঠি-উঠি করছিলেন। তারা কলকাতায় থাকেন জেনে ভদ্রমহিলা বললেন, আমার একবার কলকাতা যাবার দরকার হবে।