মেয়েকে কাছে টেনে নিয়ে মা বললে, অসময়ে ঝড়!
কে বললে?
মেয়েটি চোখ বড়ো বড়ো করে বলল-শ্যামলীদি।
শ্যামলীদি বলেছে! মা কৃত্রিম গাম্ভীর্যের সঙ্গে বললে, তবে তো সাংঘাতিক কথা। ঝড় হবেই।
–হ্যাঁ, শ্যামলীদি রেডিওতে শুনেছেন। বলে দিলেন, খবরদার কেউ সন্ধের পর বাড়ি থেকে বেরিও না।
ঠিকই তো। ঝড় এলে কেউ কি বেরোয়? আচ্ছা যাও, এখন হাত-মুখ ধুয়ে খেয়ে নাও গে।
মেয়ে পাশের ঘরে চলে গেল।
মেয়েটির বাবা ইজিচেয়ারে শুয়ে টাইমটেবল দেখছিলেন। বয়েস বেশি নয়, কিন্তু ভারিক্কি চাল। তার ওপর একটু মোটা আর ধুতির সঙ্গে গোল গলা ঢিলে-হাতা পাঞ্জাবি পরেন বলে একটু বেশি বয়েস মনে হয়। টাইমটেবল ওঁর সর্বক্ষণের সঙ্গী। ভ্রমণের ভারি নেশা। প্রতি বছরই কোথাও-না-কোথাও বেরোন। মাস কয়েক হল সপরিবারে পুরী ঘুরে এসেছেন। এখনই বেরোবার আর সম্ভাবনা নেই। তবুও নতুন কোথাও যাবার জন্যে এখন থেকেই প্ল্যান-পরিকল্পনা করছিলেন।
কলকাতায় ওঁর পৈত্রিক ব্যবসা মদের। এ এমন ব্যবসা যার মার নেই। মদের ব্যবসা কিন্তু জীবনে কখনো উনি ও জিনিসটি আস্বাদন করেননি।
ভদ্রলোক টাইমটেবলটি মুড়ে রেখে বললেন, কই? তোমার বান্ধবীটি তো এখনো এলেন না?
মান্তু মেয়ের ব্যাগ থেকে বইগুলো বের করে গুছিয়ে রাখছিল। বললে, আসবে। বলে ঘড়ির দিকে তাকাল।
কিন্তু তোমাকে আজ অন্য ঘরে শুতে হবে বলে রাখছি। আমি রীণার সঙ্গে শোব।
ভদ্রলোক যেন বিষণ্ণভাবে বললেন, উনি কি আজ থাকবেন?
–আমি তো থাকার জন্যে বলেছি। ও বলেছে, থাকতে পারবে না। তবু যদি থেকে যায়–তাছাড়া সত্যিই যদি ঝড় ওঠে, ফিরবে কি করে?
ভদ্রলোক বিরক্তির ভান করে বললেন, বুঝতে পারছি, মাঝে-মাঝেই এখন তোমার আমার মধ্যে এই তৃতীয় জনটি বাধা হয়ে দাঁড়াবেন।
মান্তু হেসে বলল, তা ঠিক। ওকে এখন প্রায়ই এখানে এনে রাখব।
ভদ্রলোক গাম্ভীর্যের ভান করে বললেন, বোধহয় পারবে না। ওঁরও তো একজন দাবীদার আছেন। তিনি আবার ডাক্তার! ডাক্তারদের অনেক এক্সট্রা সুবিধে আছে। বৌকে তাই তাঁরা চট করে কাছছাড়া করতে চান না।
শেষ কথাটার প্রচ্ছন্ন রসিকতা এড়িয়ে গিয়ে মান্তু বলল, থাকুক দাবীদার। ওকে মাঝে-মাঝে এনে না রাখলে ওর মনটা ঠিক হবে না।
ললিতবাবু জিজ্ঞেস করলেন, ওঁর ব্যাধিটা কী?
কে জানে! ছোটোবেলা থেকে তো ওকে জানি। একেবারে সুস্থ, হাসিখুশি। কোনোদিন ভারী অসুখ হতে দেখিনি। সেই মেয়েরই কী যে হল!
অসুখ-বিসুখের কথা শুনতে ললিতবাবুর ভালো লাগে না। তিনি আমোদপ্রিয় মানুষ। মদ না খেয়েও সদাই ফুরফুরে। পাছে মান্তু তার বান্ধবীর রোগের জের টানে তাই তিনি প্রসঙ্গ বদলাবার জন্যে তাড়াতাড়ি বললেন, আর এক কাপ চা sanction করো না!
মান্তু মৃদু ধমক দিয়ে বললে, একটু আগেই চা খেয়েছ। এখন আর নয়। রীণা তো এখুনি এসে পড়বে। তখন পাবে। হা, কি বলছিলাম যেন? রীণার কথা। ওর মনটা কিরকম ছিল বলি। একদিন কী একটা উপলক্ষে রীণা, রীণার মা, ঠাম্মার সঙ্গে আমিও যাচ্ছিলাম গঙ্গাস্নান করতে। হঠাৎ আমার দাদাও এসে জুটল। রীণা ছিল আমার দাদার খুব ভক্ত। দাদা পাটি করত। পড়াশোনাও ছিল খুব। কিছু মানত না। বলত, বুঝলি রীণা, লেখাপড়া শিখছিস, সংস্কারমুক্ত হবি। ঠাকুর-দেবতা, গুরু-পুরোহিত, ভূত-প্রেত স্রেফ বোগাস।
শুনে রীণার ঠাম্মা চটতেন। বলতেন, নীরেনই মেয়েটার মাথা খেল।
শ্মশানের পাশ দিয়েই স্নানের ঘাটে যেতে হয়। না তাকালেও বুঝতে পারছিলাম মড়া পুড়ছে। বিশ্রী চামসিটে গন্ধ। তার সঙ্গে ফটফট শব্দ বাবারে! ভাবলে এখনও গা কিরকম করে।
তা দাদা হঠাৎ রীণাকে বলল, পাঁচিলের গায়ে ঐ ছাইগুলো কিসের বলতে পারিস?
রীণা একনজর দেখে নিয়ে বলল, চিতাভস্ম।
–পারিস ঐ ছাই এক মুঠো নিয়ে আসতে?
সবাই চমকে উঠল।
–এ আবার কী কথা! ছিঃ!
দাদা নেহাৎ মজা করেই কথাটা বলেছিল। কিন্তু রীণা করল কি–সবাইকে হকচকিয়ে দিয়ে ছুটে গিয়ে এক মুঠো ছাই নিয়ে এল।
দাদা যে দাদা, সেও তাজ্জব হয়ে গেল। রীণার সাহস দেখে বলল-সাবাস! এই তো চাই।
দাদা তো খুব বাহবা দিল। কিন্তু আর সবার মুখ হাঁড়ি। গঙ্গাস্নানের আনন্দ মাথায় উঠল। রীণা সেদিন সবার কাছে খুব বকুনি খেল। দাদা লজ্জায় পালালো।
ভাবতে পারা যায় সেই মেয়েই এখন নাকি বোজ ভূত দেখছে! শুধু ভূত দেখাই নয়–ভূতের ভয়ে বাড়ি ছেড়ে পালাতে চাইছে!
শুনে ললিতবাবু মন্তব্য করলেন, কলকাতা শহরে ভূত!
–বোঝো, তাহলে ওর মানসিক অবস্থাটা কিরকম হয়েছে। আমি ওকে একটার পর একটা চিঠি দিয়ে, নিজে ওর সঙ্গে দেখা করে বুঝিয়েছি। কিন্তু ওর ঐ এক কথা–না, ভুল দেখি না। মানসিক রোগও নয়। এটা একটা অদ্ভুত ব্যাপার!
মান্তু একটু থামল। তারপর বলল–এই কমাসের মধ্যে মূর্তিটা বেশ কয়েকবার নাকি দেখা দিয়েছে। দেখা দেওয়াই শুধু নয়, নাকি হুমকিও দিয়েছে।
–আবার হুমকিও দিয়েছে। বাবাঃ! ললিতবাবু হাসলেন।
মান্তু রাগ করে বলল, ওর হাজব্যান্ডের মতো তোমারও দেখছি অবিশ্বাস। মেয়েটার জন্যে তোমাদের কারো এতটুকু ভাবনা হয় না!
স্ত্রীর এই তিরস্কার ললিতবাবু নিঃশব্দে হজম করতে পারলেন না। বললেন, ও-সব ভয়ের কোনো মানে হয় না। তাছাড়া যে মেয়ে হাসতে হাসতে মড়ার ছাই মুঠোয় ভরে আনতে পারে সে আবার নররাক্ষস দেখে অজ্ঞান হয় কি করে?